লিবিয়া যুদ্ধে আমি (৩য় পর্ব): গন্তব্য অজানা

শুক্রবারের পুরো দুপুর এবং বিকেল আমরা না খেয়ে কাটালাম। মাস্তুরার (বাড়িওয়ালা কামালের স্ত্রী) মায়েরা এমনিতেই গরীব, তাছাড়া গত চার মাস ধরে তাদের উপর বসে বসে খাচ্ছিল মাস্তুরার মামাতো ভাই আ’ত হারাগাদের একটা বিশাল পরিবার এবং তাদের প্রতিবেশী বু’সেফীদের পরিবার, যারা মিসরাতা যুদ্ধের সময় মিসরাতা থেকে সিরতে পালিয়ে এসেছিল। সন্ধ্যার সময় খাবার দিল, কিন্তু তা নিতান্তই অপর্যাপ্ত। শুধুমাত্র কুসকুসি, কোন মাংস বা তরকারি ছাড়াই। অবশ্য কারেন্ট না থাকার কারণে কারো বাসায় মাংস বা তরকারি আশা করাটাও বোকামী। সারাদিন ধরে শহরের ভেতর থেকে যুদ্ধের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল এবং শব্দ শুনেই বুঝা যাচ্ছিল আগের দিনের থেকেও ভয়াবহ যুদ্ধ হচ্ছে। সন্ধ্যার সাথে সাথে আওয়াজ শুনে বুঝা গেল বিদ্রোহীরা যুদ্ধ শেষ করে ফিরে আসছে। সামনের রাস্তা দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় অনেক মানুষের “আল্লাহু আকবার” শ্লোগান আমাদের কানে এল।

আমাদেরকে নামিয়ে দিয়েই মোত্তালেব গাড়ি না নিয়ে হেঁটে হেঁটে কোথায় যেন চলে গিয়েছিল। রাত নয়টার দিকে সে ফিরে এল। তার কাছে জানা গেল সে বিদ্রোহীদের ক্যাম্পে গিয়েছিল। রাস্তায় বের হয়ে সে অনুমান করে বিদ্রোহীদের ঘাঁটির দিকে হাঁটতে শুরু করে। পথেই কয়েকজন যোদ্ধা তাকে ঘিরে ফেলে। তখন সে জানায়, সে বিদ্রোহীদের সাপোর্ট করে এবং বিদ্রোহীদের সাথে কথা বলতে চায়। তখন তারা তাকে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে সে রয়টার্সের সাথেও সাক্ষাতকার দিয়ে এসেছে।

মাস্তুরার ভাইরা এবং আরো কয়েকজন মোত্তালেবকে ঘুরে ফিরে জিজ্ঞেস করতে লাগল, বিদ্রোহীরা কারা? আসলেই কি তাদের সাথে তালেবান, ফ্রেঞ্চ এবং কাতারী সৈন্য আছে? মোত্তালেব উত্তর দিল, তোমরা এখনও এইসব প্রচারণা বিশ্বাস করে বসে আছ? বিদ্রোহীরা প্রায় সবাই-ই মিসরাতী। তবে সিরতের কিছু লোকও তাদের সাথে আছে। আর তাদের ব্যবহার, সেটা আর কী বলব! আমাকে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি, জুস খেতে দিল, জিজ্ঞেস করল কোন সমস্যা আছে কি না, কোন সাহায্য লাগবে কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি।

শহরের ভেতরের কোন খবর আমরা পাচ্ছিলাম না। কামালের বড় ভাই মোহাম্মদ, যে সিরত ইউভার্সিটির ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রফেসর, সে শুধু সারা দিন রেডিও শোনার চেষ্টা করছিল। সিরত রেডিও বন্ধ, সেখানে অবিরত রেকর্ড করা গাদ্দাফীর পক্ষের গান চলছিল। সন্ধ্যা ছয়টার সময় মিসরাতা রেডিওর সংবাদে বলা হল, মিসরাতার যোদ্ধারা সিরতের সাবা কিলোর (মাস্তুরার মায়েদের এই এলাকাটাই) পূর্ণ দখল নিয়েছে। আগের দিন তারা সিরতের পশ্চিমে অবস্থিত জারফ প্রায় বিনা বাধায় দখল করে নিয়েছিল। তাছাড়া তাদেরই একটা গ্রুপ ভাগ হয়ে সিরতের দক্ষিণ দিক দিয়ে ঘুরে পূর্ব দিকে অবস্থিত গার্দাবীয়া দখল করে নিয়েছে এবং আবুহাদীর দিকে এগোচ্ছে। তারা বেনগাজীর যোদ্ধাদের সিরতের দিকে আর এগোতে নিষেধ করেছে, তাদের আশা সিরত দখলের জন্য তারাই যথেষ্ট। সিরতের কেন্দ্রে অবস্থিত সাততলা উঁচু একসারি আবাসিক ভবনের (ইমারাত তা’মিনের) উপর ন্যাটোর বোমা হামলার সংবাদও বলা হল এতে।

রাতের বেলা ন্যাটোর উড়াউড়ি ছাড়া আর নতুন কিছু ঘটল না। এই প্রথম সিরতের আকাশে ন্যাটো ফাইটারের পাশাপাশি অ্যাপাচি হেলিকপ্টারও উড়ালো। রাতে অবশ্য ভালো ঘুম হলো না। ছোট একটা ঘরে আমরা বিশ থেকে পঁচিশজন মানুষ ঘুমালাম। ঘরের চারদিকে নিচে বিছানো ম্যাট্রেসে মাথা রেখে পাগুলো ঘরের কেন্দ্রের দিকে ছড়িয়ে দিল সবাই। ফলাফল হল, বিভিন্নজনের পা পরস্পরের সাথে ওভারল্যাপ হতে লাগল।

পরদিন শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সারার পরপরই দেখি আমাদের দুই বাসা পরের আইয়্যাদ হোয়েদারদের ফ্যামিলিও এখানে এসে হাজির। আইয়্যাদ বলল গতকাল সকালে সে ইবনে সীনা হসপিটালে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার আগেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বাসা থেকে এক কিলোমিটার দূরে থাকতেই তার গাড়ির উপর দিয়ে একটা রকেট উড়ে গিয়ে পেছনের গাড়িকে উড়িয়ে দেয়। ফলে সে ভয় পেয়ে গাড়ি ফেলে গলির ভেতর দিয়ে দৌড়ে বাসার দিকে এগিয়ে যায়।

বাসার কাছাকাছি আসার পরে একটা রাস্তার দিকে উঠতে হয়, তাই রাস্তা এড়ানোর জন্য সে কাছাকাছি একটা বাসায় ঢুকে পড়ে পাঁচিল টপকে পার হওয়ার জন্য। সেই বাসায় দুইজন তাওয়ার্গী নিগ্রো লিবিয়ান ছিল। আইয়্যাদ দেখতে পেল একজন মাথায় গুলি খেয়ে মরে পড়ে আছে আরেকজন তাকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। দুজন মিলে লাশটাকে একপাশে সরিয়ে দেয়াল টপকে টপকে অবশেষে আইয়্যাদের বাসায় পৌঁছল। ঘরে পৌঁছানো মাত্রই তারা বিদ্রোহীদের আল্লাহু আকবার ধ্বনি শুনতে পায়। তাকিয়ে দেখে বিদ্রোহীদের পতাকা লাগানো অনেকগুলো গাড়ি সমুদ্রের পাড়ের উঁচু রাস্তাটা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। আইয়্যাদ আর তার ছেলে আহমেদ মিলে গুনেছিল সর্বমোট তেষট্টিটা গাড়ি সামনে এগিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ পর আবার একই রাস্তা ধরে ফিরে এসেছে।

শনিবারেও দুপুর এগারোটার দিকে যুদ্ধ শুরু হল। যুদ্ধ শুরুর কিছুক্ষণ পরেই ঘনঘন গ্র্যাড মিজাইল পড়ার বিকট আওয়াজ শোনা যেতে লাগল এবং তার পরপরই বিদ্রোহীরা ফিরে এল। কিছুক্ষণ পরে অবশ্য তারা আবার এগুলো। দুপুর দুইটার দিকে একটা ভয়াবহ ব্যাপার ঘটল। আমরা অনেকগুলো গাড়ির আওয়াজ শুনে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম বিদ্রোহীদের ছয়টা অস্ত্রবাহী জীপ এবং পিকআপ কিছু দূরের একটা বাড়ির সামনে গিয়ে থামল এবং কয়েকজন যোদ্ধা সেই বাড়ির ভেতরে গিয়ে ঢুকল। সেই বাড়িটাতে একটা সুদানী ফ্যামিলি ছিল। তার একটু পরেই তার পাশের বাড়ি থেকে মহিলা এবং বাচ্চাকাচ্চারা চিত্‍কার করতে করতে বেরিয়ে এল। পুরো এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ল বিদ্রোহীরা সুদানী মহিলাকে ধরে নিয়ে গেছে। মহিলাদের মধ্যে একটা আতংক ছড়িয়ে পড়ল। আ’তেফ এবং আ’তেফের স্ত্রী মবরুকা বলতে লাগল তারা কোনমতেই আর এই এলাকায় থাকবে না। এখানে কোন নিরাপত্তা নেই। যেকোন সময় বিদ্রোহীরা এই বাসায়ও এসে আক্রমণ করতে পারে। এখানে থাকার চেয়ে বাসায় গিয়ে যুদ্ধ করাও বরং আরো ভালো।

দুপুরের খাবারের পর আমরা বসে বসে মিসরাতা থেকে আসা হারাগা আর বুসেফী পরিবারের ছেলেগুলোর সাথে কথা বলছিলাম। তখন একটা মজার ব্যাপার লক্ষ করলাম। প্রথম প্রথম তারা আমাদের সাথে এমন ভাবে কথা বলছিল, যেন তারা গাদ্দাফীর সাপোর্টার। গাদ্দাফী অতুলনীয় নেতা, বিদ্রোহীরা দেশদ্রোহী, ইত্যাদি। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন বুঝল আমরা গাদ্দাফীর বর্তমান নীতির খুব একটা সমর্থক না, বা আমাদের সাথে সত্য কথা বললে নিজেদের কোন ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, তখন তারা স্বীকার করল তারা মিসরাতা থেকে পালিয়েছে মূলত গাদ্দাফীর সৈন্যদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে।

সেখানে একটা ছেলের মোবাইল ফোনে একটা ভিডিও দেখলাম যেটা আগে কখনো টিভিতে দেখিনি। ভিডিওটা ত্রিপলীর গ্রীণ স্কয়ারের, গোলমালের প্রথম সপ্তাহের, যেদিন গাদ্দাফীর ভেনেজুয়েলায় পালানোর গুজব উঠেছিল। ভিডিওতে দেখা গেল গ্রীণ স্কয়ারে এক-দেড়শো মানুষ জড়ো হয়ে গাদ্দাফীর বিপক্ষে শ্লোগান দিচ্ছে, গাদ্দাফীর ছবি জ্বালাও-পোড়াও করছে, সাইনবোর্ড ভাংচুর করছে। তাদের বেশিরভাগই খালি হাতে, কয়েকজনের হাতে শুধু লাঠি। এমন সময় দশ-পনেরোটা আর্মির জীপ এবং পিকআপ এল, পেছনে মেশিনগান ফিট করা। হঠাৎ মেশিনগানের গুলি শুরু হল। কয়েকজন আন্দোলনকারী মাটিতে পড়ে গেল, আল্লাহু আকবার ধ্বনি শোনা যেতে লাগল আর বেশিরভাগই পালাতে লাগল। কিছুক্ষণ পরেই গাদ্দাফী সমর্থকরা সবুজ পতাকা হাতে “আল্লাহ্ মোয়াম্মার ওয়া লিবিয়া ওয়া বাস” শ্লোগান দিয়ে গ্রীণ স্কয়ারে ঢুকতে লাগল। ত্রিপলীর আবু সেলিম তথা বুসলিমেরও ঠিক একই ধরনের আরেকটি ভিডিও দেখা গেল। আন্দোলনকারীরা সংখ্যায় এতো কম ছিল যে, ইচ্ছে করলে সাধারণ পুলিশই তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। কিন্তু তা না করে নির্মমভাবে তাদের দমন করা হলো, যেন তারা ভবিষ্যতেও আর মিছিল বের করার সাহস না পায়।

শনিবার বিকেলের দিকে গাদ্দাফী সিরিয়া ভিত্তিক আল-রাই টিভিতে অডিও ভাষণ দিল। ভাষণে গাদ্দাফী বিদ্রোহীরকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হওয়ায় রক্বম এতনীন এবং জাফরানের ভূয়সী প্রশংসা করল। উল্লেখ্য আমাদের বাসাটা জাফরানের একেবারে পূর্বপ্রান্তে তথা রক্বম এতনীনের পশ্চিমপ্রান্তে অবস্থিত। এই এলাকাদুটোর অধিবাসীদের অধিকাংশই হামামলা ক্বাবিলার অন্তর্গত এবং এদেরকে বলা হয় হাম্মালী বা বিন হাম্মাল। গাদ্দাফী তার ভাষণে বিন হাম্মালদেরও প্রশংসা করল। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে, পরিচিত এমন কয়েকজনের নামও বলল। ত্রিপলী পতনের পর সিরতকে রাজধানী ঘোষণা করা হয়েছিল, এবার গাদ্দাফী আশ্বাস দিল সিরত রক্ষা করতে পারলে পরবর্তীতে সিরতকেই স্থায়ীভাবে রাজধানী রাখা হবে।

সন্ধ্যার দিকে মাস্তুরার মায়েদের বাড়িতে মানুষের সংখ্যা আরো বেড়ে গেল। বু’আরাবীয়াদের ফ্যামিলি এসে জানালো, তাদের ঘরের দোতলায় মিজাইল পড়ে আগুন ধরে গেছে। ঐ অবস্থাতেই তারা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। তারা জানালো আজ বিদ্রোহীরা সাবা’ মিয়া নামক এলাকার ভেতরেও ঢুকেছে। আ’তেফ আর কামাল অবশ্য এসব কথা বিশ্বাস করতে রাজি না। তাদের দাবি, বিদ্রোহীরা সংখ্যায় কম, মাত্র দশ-বারোটা গাড়ি। তারা এখনও কবরস্থানের সামনেই যেতে পারে নি। যদি তারা সংখ্যায় এতো বেশিই হতো, তাহলে পুরো শহর দখল করে ফেলে না কেন?

রাতের বেলা দুপুরের গুজবের সঠিক খবরটা পাওয়া গেল। সকালের দিকে বিদ্রোহীরা যখন প্রচন্ড মিজাইল আক্রমণের কারণে পিছু হটছিল, তখন তারা এই এলাকার ভেতরে গুলির আওয়াজ শুনেছিল। তাই তারা সন্দেহজনক কয়েকটা বাসায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ করে। তারা কাউকে কিছু না বলে শুধুমাত্র অস্ত্র নিয়েই চলে গেছে, কিন্তু পাশের বাসার মহিলারা এতোগুলো গাড়ি ভর্তি বিদ্রোহী যোদ্ধা দেখে ভয় পেয়ে চেঁচামেঁচি শুরু করে এবং ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। কিন্তু এই সংবাদ শুনেও আ’তেফ আর মবরুকা প্রভাবিত হল না। তারা এই এলাকাতে থাকবেই না। তার ভাই কামাল এবং মোহাম্মদ অনেক বুঝানোর চেষ্টা করল কিন্তু কোন লাভ হল না।

শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল সবাই মিলে মাস্তুরার ভাই মোস্তফার শ্বশুর বাড়ি ‘আশরিনে যাবে। ‘আশরিন সিরতের পূর্বদিকে বিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিতএকটি গ্রাম্য এলাকা। ঐদিকটা এখনও গাদ্দাফীর দখলে। গাদ্দাফীর পক্ষের লোকেদের দাবি পূর্বদিকে ব্রেগা পর্যন্ত প্রায় ২৫০ কিলোমিটার গাদ্দাফীর দখলে। তবে জাজিরা, বিবিসি সহ সংবাদ মাধ্যমগুলোর আরো দুই সপ্তাহ আগের সংবাদ এবং ভিডিও অনুযায়ী বেনগাজীর বিদ্রোহী যোদ্ধারা ওদিকে সত্তর কিলোমিটার দূরে হারাওয়াতে অবস্থান করছে। বিদ্রোহীরা সাধারণত দুপুর এগারোটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ করে, তাই আমাদেরকে সকাল সকালই যাত্রা শুরু করতে হবে।

রবিবার সকাল আটটার দিকে আমরা সাবা কিলো থেকে আমাদের বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ‘আশরিনে যাব। মেইন রোড দিয়ে বাসায় যাওয়ার সময় যে দৃশ্য দেখলাম, তার সাথে তুলনা করার মতো দৃশ্য কোন সিনেমাতেও কখনো দেখিনি। রাস্তার দুইপাশের প্রত্যেকটা বাড়ি গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা ঝাঁঝরা হয়ে আছে, রকেট আর মর্টারের আঘাতে দেয়ালগুলো ভেঙ্গে চুরে পড়ে আছে। রাস্তায় কিছুদূর পরপর মানুষের গাড়ি পড়ে আছে। গাড়িগুলোর কাঁচ ভাঙ্গা, দরজা খোলা, সামনের রাস্তায় তাজা রক্তের দাগ। রাস্তায় যতদূর চোখ যায়, শুধু বুলেট আর মিসাইলের খোসা। বুলেটের খোসার কারণে গাড়ির চাকা পিছলে পিছলে যাচ্ছে। বিন হাম্মাল মসজিদের মিনারের একটা পাশ ভেঙ্গে আছে। সবচেয়ে অবাস্তব একটা দৃশ্য হল, হাইওয়ের এক পাশের লেন দিয়ে আমাদের (মাস্তুরার ভাইয়ের ছেলে মোহাম্মদ ওয়াফীর) গাড়ি চলছে, আর পাশের লেন দিয়ে বিশালাকৃতির তিনটা উট রাজকীয় ভঙ্গিতে পা ফেলে এগিয়ে আসছে। কারো খামারে ছিল নিশ্চয়ই, গোলাগুলিতে বেরিয়ে পড়েছে।

বাসায় গিয়ে মাত্র জামাকাপড় গোছানো শুরু করেছি, এমন সময় মোহাম্মদ ওয়াফী চিত্‍কার শুরু করল, তাড়াতাড়ি। ইচ্ছা ছিল সময় পেলে নবী স্যার আর রমজান আংকেলরা কী অবস্থায় আছে সেটা দেখে যাওয়ার, কিন্তু সে সময় আর হল। পুনরায় যাত্রা শুরু হল। আমাদের বাসা ছেড়ে একটু সামনেই যেই চৌরাস্তার মোড়, সেখানে দেখলাম গাদ্দাফী বাহিনী চার-পাঁচটা ট্রাক আড়াআড়ি ফেলে রেখে রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। ট্রাকগুলোর আড়ালে সাত-আট জন যোদ্ধা মেশিনগান আর রকেট লঞ্চার নিয়ে রেডি হয়ে আছে। শহরের পশ্চিম দিকে এটাই গাদ্দাফী বাহিনীর প্রথম বাধা। অর্থাৎ আমাদের বাসাটা এখন আর গাদ্দাফীর নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নেই, আছে নো ম্যান’স ল্যান্ডে।

শহরের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় ন্যাটোর বোমা মারা সাততলা উঁচু ভবনগুলো এবং তার পাশের এমহাম্মেদ ক্যাফেটেরিয়াটা দেখলাম। যেই সাততলা ভবনটার উপর বোমা মেরেছে, সেটার চিহ্নও আর অবশিষ্ট নেই। পুরো সাততলা একেবারে মাটির সাথে মিশে গেছে। চারপাশের রাস্তায় ভাঙ্গা টুকরো ছড়িয়ে পড়ে আছে। রক্বম তালাতার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শামীম-শাওনদের সাথে দেখা হল। ওরা তখন পর্যন্ত জানে না, বিদ্রোহীরা শহরের এতো ভিতরে ঢুকে গেছে।

প্রায় আধঘন্টা চলার পরে আমরা ‘আশরিনে এসে পৌঁছলাম। শহরের ভেতরে ততক্ষণে পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এ জায়গাটা প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরে বলে এখানে শব্দ এসে পৌঁছাতে পারছে না। জায়গাটা পুরাই গ্রামাঞ্চল। বিশাল একটা একতলা বাড়ি, বিশাল তার গেস্টরুম। মহিলারা ভেতরে চলে গেল আর পুরুষদের স্থান হল বিশাল গেস্টরুমটাতে। পৌঁছানোর সাথে সাথেই নাস্তা এল। বেশ ভালো নাস্তা। তবে আমরা সব মিলিয়ে মোট ত্রিশ জনের মতো এসেছি, শোনা যাচ্ছে আরও আসবে। দোকান-পাট সব বন্ধ, যে আগে যতটুকু খাবার-দাবার জমাতে পেরেছিল সেটাই এখন ভরসা। কতদিন আমাদের এখানে থাকতে হবে আর কতদিন এরা এতো মানুষকে খাওয়াতে পারবে, কে জানে?

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান