‘লিবিয়ার শতবর্ষের নির্জনতা’ : মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার সাক্ষাৎকার

ইরফানুর রহমান রাফিন একজন জনপ্রিয় ব্লগার। সম্প্রতি তিনি নিজের ব্লগে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষাৎ প্রকাশ করা শুরু করেছেন। প্রথম সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জনপ্রিয় রাজনৈতিক সমালোচক অনুপম দেবাশীষ রয়ের। আর দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারটি ছিল আমার।

এই সাক্ষাৎকারে লিবিয়ার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, গাদ্দাফীর উত্থান, তার শাসণামলের ভালোমন্দ দিকগুলো, ২০১১ সালের বিদ্রোহের সূচনা, দেশী-বিদেশী শক্তির প্রভাব, বিদ্রোহ পরবর্তী লিবিয়ার রাজনীতি, আল-ক্বায়েদা-আইসিসের উত্থান, তাদের ক্ষমতার উৎস, লিবিয়ার ভবিষ্যৎ সহ অনেক কিছু উঠে এসেছে।

মূল সাক্ষাৎকারটি পড়তে পারেন এই লিংক থেকে

ইরফানুর রহমান রাফিনঃ কেমন আছেন, ভাই?

মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহাঃ ভালো। আপনি কেমন আছেন?

রাফিনঃ ভালো। আপনার জন্ম ও বেড়ে ওঠা কি লিবিয়ায়? পড়াশোনা ও চাকরিও?

ত্বোহাঃ না, আমার জন্ম বাংলাদেশে। কিন্তু আমি খুব ছোট থাকতে লিবিয়ায় এসেছি। ১৯৯০ সাল থেকে আমি লিবিয়ায় আছি আব্বা আম্মার সাথে। হ্যাঁ, পড়াশোনা করেছি এখানকার বাংলাদেশি স্কুলে, পরবর্তীতে লিবিয়ান ইউনিভার্সিটিতে। চাকরিও করছি এখানেই।

রাফিনঃ আচ্ছা। গাদ্দাফী ক্ষমতায় আসার আগে লিবিয়ার যে-রাজনৈতিক ইতিহাস তা সংক্ষেপে আমাদেরকে একটু বলবেন কি? খুব প্রাচীন আমলের ইতিহাসের অবশ্য প্রয়োজন নেই, ইতালি যখন লিবিয়াকে উপনিবেশ বানালো, সেই সময় থেকে বললেই চলবে!

ত্বোহাঃ আচ্ছা। অটোমান সাম্রাজ্যের কাছ থেকে ইতালি লিবিয়া দখল করে ১৯১১ সালে। সে সময় ওমর আল-মুখতারের নেতৃত্বে লিবিয়ানরা ইতালিয়ানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেই ওমর আল-মুখতার, যাকে নিয়ে লায়ন অফ দ্যা ডেজার্ট চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে। ২০ বছরের সংগ্রামের পর ১৯৩১ সালে ওমর আল-মুখতার ধরা পড়েন, তাকে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং লিবিয়ান রেজিস্ট্যান্স এক প্রকার ধ্বংস হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী বাস্তবতায় জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় লিবিয়া স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৫১ সালে। এর নতুন নাম হয় ইউনাইটেড কিংডম অফ লিবিয়া, রাজা হন ইদ্রিস আল-সেনুসী। রাজা ইদ্রিস চরিত্রটা বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল। তিনি সেনুসী আন্দোলনের একজন নেতা। তার পূর্বপুরুষেরা এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে ব্যাপক কাজ করেছেন। তিনি নিজেও অল্পবয়সে ইতালিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। ওমর আল-মুখতারও সেনুসী আন্দোলনেরই একজন নেতা। কিন্তু পরবর্তী জীবনে ইদ্রিস সংগ্রামের পরিবর্তে ব্রিটিশদের মধ্যস্থতায় ইতালিয়ানদের সাথে সমঝোতার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। স্বাধীনতার পর তিনি মার্কিন, ব্রিটিশ ও ইতালিয়ান তেল কোম্পানীগুলোকে লিবিয়ার তেল উৎপাদনের দায়িত্ব দেন। আমার যদি সঠিক মনে থাকে, তাহলে সম্ভবত লিবিয়ার ২০ শতাংশ আর কোম্পানীগুলোর ৮০ শতাংশ – এরকম চুক্তিতে। মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনা ঘাঁটিকেও তিনি লিবিয়াতে স্থান দেন। অর্থাৎ, সহজ ভাষায় তিনি জাতীয়তাবাদবিরোধী পশ্চিমপন্থী একজন রাজা হয়ে উঠেছিলেন।

রাফিনঃ অর্থাৎ আমরা বলতে পারি ওমর আল-মুখতারের নেতৃত্বে যে উপনিবেশবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিলো সেটার পতন ঘটলো সাবেক উপনিবেশিক শক্তিদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা রাজা ইদ্রিসের মসনদে বসার মাধ্যমে?

ত্বোহাঃ হ্যাঁ। বলা যায়। ওমর আল-মুখতার জীবিত থাকাকালেই শেষ দিকে ইদ্রিস সহ আরো কিছু নেতার সাথে তার খুব একটা সুসম্পর্ক ছিল না। তারা তখন থেকেই তিনি সমঝোতায় আগ্রহী ছিলেন। ওমরের মৃত্যুর পর সেটা কার্যকর হয়েছিল।

রাফিনঃ আচ্ছা। সেনুসী আন্দোলন সম্পর্কে আমাদেরকে সংক্ষেপে কিছু বলুন। ওয়াহাবিদের সাথে সেনুসীদের কোনো সম্পর্ক ছিল, নাকি এঁরা স্বতন্ত্র একটি ধারা ছিলেন?

ত্বোহাঃ না, এটা ভিন্ন একটা ধারা। এবং আমি যতটুকু পড়েছি বলে মনে পড়ে, গ্র্যান্ড সেনুসীকে ওয়াহাবিদের সাথে মতপার্থক্যের কারণে সৌদি আরব থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। সেনুসী আন্দোলন কিছুটা সূফিঘেঁষা ছিল। হয়তো বলা যায় এটা সালাফি ইসলাম এবং সূফি ইসলামের মাঝামাঝি একটা ধারা।

রাফিনঃ আচ্ছা, ওমর আল-মুখতারদের যে-উপনিবেশবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, সেটায় তাহলে সূফী ইসলামের প্রভাব ছিলো? মানে যেহেতু আপনি বলছেন সেনুসী আন্দোলন সূফীঘেঁষা… এই কারণেই বলছি।

ত্বোহাঃ সেনুসী আন্দোলন সূফীঘেঁষা বলাটা হয়তো ঠিক না, সেনুসীদের ইসলাম শিক্ষা হয়তো সূফীঘেঁষা। এ-বিষয়ে বরং আর না বলি, কোনটা ঠিক সূফী আর কোনটা সালাফি – এটা যাঁরা ধর্ম বিষয়ে আরো ভালো জ্ঞান রাখেন তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন। আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, ওমর আল-মুখতার ইতালিয়ানদের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করেছেন, সেটাকে আপনি ইসলামের দৃষ্টিতেই দেখেন আর জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিতেই দেখেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের জন্য অবিচল সংগ্রামের এরকম দৃষ্টান্ত বিরল।

রাফিনঃ একমত। এবার একটু রাজা ইদ্রিসের ব্যাপারে কথা বলি। উনি জনগণের দৃষ্টিতে শাসক হিসেবে কেমন ছিলেন?

ত্বোহাঃ জনগণের দৃষ্টি বোঝা একটু কঠিন। আমরা বড় হয়েছি গাদ্দাফীর আমলে। এবং আমরা যাদেরকে দেখেছি, তারাও বড় হয়েছি গাদ্দাফীর আমলে। গাদ্দাফী স্বভাবতই ইদ্রিসকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। গাদ্দাফীর আমলে ১৯৫১ সালের ২৪শে ডিসেম্বর যে লিবিয়া স্বাধীনতা লাভ করেছিল, সেটাও পালন করা হতো না। ইদ্রিসের পক্ষে ২০১১ সালের বিদ্রোহের পরে টিভিতে এবং নেটে অল্প কিছু মানুষকে ছাড়া সরাসরি কাউকে কথা বলতে দেখিনি। তার জনপ্রিয়তা একেবারেই কম ছিল বলেই মনে হয়েছে।

রাফিনঃ গাদ্দাফী কতো সালে রাজা ইদ্রিসকে ক্ষমতাচ্যুত করেন?

ত্বোহাঃ ১৯৬৯ সালে। সেপ্টেম্বরের ১ তারিখে। গাদ্দাফীর বয়স ছিল তখন মাত্র ২৭ বছর।

রাফিনঃ সেদিন এগজেক্টলি কী ঘটেছিলো? অর্থাৎ কিভাবে রাজা ইদ্রিস ক্ষমতাচ্যুত হলেন? এটা সংক্ষেপে বলবেন?

ত্বোহাঃ রাজা ইদ্রিস তার শাসনের শেষদিকে অজনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন। অন্যদিকে গাদ্দাফী ছোটবেলা থেকেই মিশরের জামাল আব্দুল নাসেরের আরব জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা দ্বারা খুবই প্রভাবিত ছিলেন। হাইস্কুলে পড়াকালেই আন্দোলন করার অভিযোগে গাদ্দাফী স্কুল এবং সাবহা শহর থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। বেনগাজী মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে চান্স পাওয়ার পরপরই গাদ্দাফী সমমনা জুনিয়র অফিসারদেরকে নিয়ে নাসেরের আদলে ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্ট শুরু করেন। ১৯৬৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর রাজা ইদ্রিস যখন চিকিৎসার জন্য তুরস্কে গিয়েছিলেন, গাদ্দাফীর নেতৃত্বে তার অনুগত অফিসাররা মাত্র দুই ঘন্টার মধ্যে বিনা রক্তপাতে বেনগাজী এবং ত্রিপলীর দখল নিয়ে নেয়।

রাফিনঃ মাত্র দুই ঘন্টায়?

ত্বোহাঃ হ্যাঁ, তাদেরকে বাধা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। জাস্ট এয়ারপোর্ট, রেডিও স্টেশন সহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে যেতে তাদের যতটুকু সময় লেগেছে।

রাফিনঃ বোঝাই যাচ্ছে রাজা ইদ্রিসের গদি বাঁচানোর ব্যাপারে লিবিয়ার জনগণের কোনো মাথাব্যথাই ছিল না।

ত্বোহাঃ হ্যাঁ। লিবিয়ানরা দীর্ঘদিন ইতালিয়ান উপনিবেশিক শাসকদের হাতে যে কঠোর নির্যাতন সহ্য করেছিল, সেই স্মৃতি নিয়ে তারা ইদ্রিসের পশ্চিমঘেঁষা নীতি সম্ভবত ভালো চোখে দেখেনি। তাছাড়া গাদ্দাফী এর আগে কয়েক বছর ধরে বেশ গণসংযোগও করেছিলেন। এবং গাদ্দাফী নিঃসন্দেহে একজন ক্যারিজমাটিক নেতা ছিলেন।

রাফিনঃ গাদ্দাফী কি তার এই ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্টের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে সে’সময়কার কোনো পরাশক্তির সমর্থন পেয়েছিলেন? লাইক সোভিয়েত ইউনিয়ন? যেহেতু ইদ্রিস পশ্চিমঘেঁষা ছিলেন, গাদ্দাফি তাঁকে সরিয়েছেন…

ত্বোহাঃ মনে হয় না। এরকম অভিযোগ কখনও শুনি নি। সে সময় গাদ্দাফী পশ্চিমাদেরকে এবং কমিউনিস্টদেরকে একইরকম ঘৃণা করতেন। তার মধ্যে ইসলামি এবং আরব জাতীয়তাবাদের প্রভাব ছিল। যদিও পরে তার নীতি অনেকটাই পরিবর্তিত হয়।

রাফিনঃ আচ্ছা। গাদ্দাফীর এই টেকওভারকে লিবিয়ানরা কি ওয়েলকাম করেছিলেন? মানে ইন জেনারেল?

ত্বোহাঃ হ্যাঁ। গাদ্দাফীর ভাষণে জনসমাবেশ দেখলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়। লিবিয়ার জন্য ঐ সময়ে এতো বিশাল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি অকল্পনীয় ছিল।

রাফিনঃ আমি বুঝতে পারছি! পশ্চিমঘেঁষা শাসককে উৎখাত করেছেন, তিরিশ-না-পেরোনো এক তরুণ। বেশ রোম্যান্টিক একটা ব্যাপার বলা যায়, না?

ত্বোহাঃ হ্যাঁ। আর গাদ্দাফী তার ভাষণে বারবার নিজেকে ওমর আল-মুখতারের আদর্শে উদ্বুদ্ধ বলে প্রচার করেছিলেন। এমনকি, জনগণের উদ্দেশ্যে প্রথম ভাষণটাও তিনি দিয়েছিলেন ১৬ই সেপ্টেম্বর, ওমর আল-মুখতারের শাহাদাত বার্ষিকীতে।

রাফিনঃ স্বাভাবিক। আচ্ছা। এবার গাদ্দাফির শাসনামল নিয়ে কথা বলা যাক! গাদ্দাফি ক্ষমতায় এসে কী কী পরিবর্তন আনেন?

ত্বোহাঃ ক্ষমতায় আসার পরপরই গাদ্দাফী মার্কিন এবং ব্রিটিশ সেনা ঘাঁটিগুলো উচ্ছেদ করলেন, ইতালিয়ান তেল কোম্পানীগুলোকে এবং ইতালিয়ানদেরকে ও ইহুদী সম্প্রদায়কে বহিষ্কার করলেন, তেল সম্পদ জাতীয়করণ করলেন, সবগুলো পুরানো চুক্তি বাতিল করে নতুন চুক্তি করলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি করলেন – এক বছরের মধ্যে তিনি লিবিয়ার অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসলেন। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও বেশ কিছূ পরিবর্তন এনেছিলেন। সম্ভবত অ্যালকোহল নিষিদ্ধ করা, ক্লাব বন্ধ করাসহ বেশ কিছু অনৈসলামিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছিলেন।

রাফিনঃ ইহুদি সম্প্রদায়কে বহিষ্কার… উনি কি এন্টিসেমেটিক ছিলেন? লাইক এডলফ হিটলার? নাকি সিদ্ধান্তটির পেছনে অন্য কোনো কারণ ছিল?

ত্বোহাঃ ফিলিস্তিনীদের প্রতি গাদ্দাফী বেশ সহানুভূতিশীল ছিলেন। মধ্যপ্রাচ্য সংকটের কারণ হিসেবে তিনি স্বাভাবিকভাবেই ইসরাইল এবং ইহুদীদেরকে দায়ী মনে করতেন। অন্য অনেকেই হয়তো সেরকমই মনে করে, কিন্তু সে সময়ের তরুণ গাদ্দাফীর হয়তো আবেগ বেশি ছিল। তিনি এরপরও দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনের পক্ষে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরকে ফান্ডিংয়েও তার ভূমিকা ছিল। মিউনিখ ম্যাসাকারে নিহত ফিলিস্তিনীদের লাশ তিনি লিবিয়ায় নিয়ে গেছিলেন এবং জীবিতদেরকে লিবিয়ায় বীরের সংবর্ধনা দিয়ে বরণ করে নিয়েছিলেন।

রাফিনঃ তাহলে ইজরায়েল নিশ্চয়ই তাঁর প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিল?

ত্বোহাঃ থাকার কথা। কিন্তু ইসরায়েল সরাসরি তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি না, আমার ঠিক জানা নেই। তবে সিআইএ দীর্ঘদিন তাকে উচ্ছেদ করার জন্য বিভিন্ন সংগঠনকে ফান্ডিং করেছে – এটা তো আমরা সবাই জানি!

রাফিনঃ এখানে একটা বিষয় একটু পরিষ্কার করা দরকার। ইজরায়েল ১৯৪৮ থেকেই ফিলিস্তিনিদের সাথে যা করেছে তা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে সমর্থন করা সম্ভব নয়। ইজরায়েলের প্রতি ঘৃণা থাকা তাই খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ইজরায়েল একটা রাষ্ট্র, ইহুদিরা একটা সম্প্রদায়। তুরস্ক যেমন একটা রাষ্ট্র, মুসলমানরা একটা সম্প্রদায়। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, গাদ্দাফীর ইজরায়েল বিরোধিতা কি শুধুই ফিলিস্তিনিদের সাথে ইজরায়েলের করা অন্যায়ের তীব্র প্রতিক্রিয়া ছিলো? নাকি ইহুদিদের প্রতি গাদ্দাফির ভেতর কোনো সাম্প্রদায়িক ঘৃণা কাজ করেছে জার্মানির নাজিদের মতো?

ত্বোহাঃ আমার ঠিক জানা নেই। যদিও স্বাভাবিকভাবে শুধু ধর্মের অভিযোগে কোনো সম্প্রদায়কে রষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা ন্যায়সঙ্গত না, কিন্তু সে সময় ইহুদী সম্প্রদায়দের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল কি না, সেটা না জেনে মন্তব্য করাটা কঠিন। তবে হিটলারের সাথে তুলনা করা কঠিন হবে। গাদ্দাফী শুধু দেশ থেকেই বহিষ্কার করেছেন, কাউকে মৃত্যুদন্ডও দেন নি, বা নির্যাতনও করেন নি। ইন ফ্যাক্ট, প্রথমদিকে গাদ্দাফী যাদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তাদের কাউকেই মৃত্যুদন্ড দেন নি। হয়তো বহিষ্কার করেছিলেন, অথবা বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দিয়েছিলেন।

রাফিনঃ আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। নারীদের ব্যাপারে গাদ্দাফী সরকারের নীতি কেমন ছিল? নারী অধিকার বিষয়ে?

ত্বোহাঃ এ ব্যাপারে গাদ্দাফী বেশ প্রগ্রেসিভ ছিলেন বলা যায়। মেয়েদের জন্য চাকরির ক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টি করা, বেতন পুরুষদের সমান করাসহ সে সময়ের প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু র‍্যাডিকাল পরিবর্তন এনেছিলেন তিনি। পরবর্তীতেও গাদ্দাফীর মেয়ে আয়েশা গাদ্দাফী নারীদের খেলাধুলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন।

রাফিনঃ হ্যাঁ, এটা আমি আমার বন্ধু নাদিয়া ইসলামের কাছেও শুনেছি যিনি তাঁর আব্বার চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশবে লিবিয়ায় ছিলেন।

ত্বোহাঃ নারীদের ব্যাপারে আরেকটা কথা বলি, হয়তো এটা লিবিয়ানদের ট্রাইবাল সিস্টেমের কারণেই, কিন্তু সুপ্রীম লীডার হিসেবে গাদ্দাফীর অবদানটাও স্বীকার করতে হবে। সেটা হচ্ছে, লিবিয়াতে নারীদেরকে যেরকম শ্রদ্ধা করা হয়, সেটা সম্ভবত বিশ্বে বিরল। ২০১১ সালের পর লিবিয়া সব দিক থেকে বলা যায় ধ্বংস হয়ে গেছে, তাদের সোশ্যাল ফ্যাব্রিক নষ্ট হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও যদি গাড়িতে মহিলা থাকে তাহলে চেকপয়েন্টগুলোতে চেক না করেই ছেড়ে দেওয়া হয়। অথবা চেক করলেও শুধু পুরুষদের আইডি কার্ডই চেক করা হয়, মহিলাদের না। সেজন্য দেখা যায়, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে যেখানে পুরুষরা রাতের বেলা মহিলাদেরকে সাথে নিয়ে বেরোতে ভয় পায়, লিবিয়াতে উল্টো। এখানে অনেকেই রাতের বেলা বের হতে হলে সাথে স্ত্রী অথবা মা-বোনকে নিয়ে নেয় বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য।

রাফিনঃ ট্রাইবাল সিস্টেমের কথা যখন চলে আসলো তখন এটা নিয়ে একটু আলাপ করা যাক। গাদ্দাফী এই ট্রাইবাল সিস্টেমকে ঠিক কিভাবে দেখতেন। নানান ট্রাইবের মধ্যে ব্যালেন্স কিভাবে ধরে রাখতেন?

ত্বোহাঃ ট্রাইবের ব্যাপারে আমরা প্রায়ই অভিযোগ শুনি, বিশেষ করে মিডিয়াতে, যে গাদ্দাফী নিজে ক্ষমতায় থাকার জন্য ট্রাইবাল সিস্টেমকে এক্সপ্লয়েট করতেন, তাদের মধ্যে বিবাদ লাগিয়ে রাখতেন। কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা সেরকম মনে হয়নি। গাদ্দাফীর আমলে আমরা ট্রাইবাল ফিউড বা ট্রাইবাল ওয়ার খুব কমই দেখেছি। বরং গাদ্দাফীর পতনের পরই দেখা গেছে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে। আমার এক কলিগ ছিল, সে একবার গল্প করছিল, তারা যখন ছোট ছিল, সত্তরের দশকের শেষ দিকে, তখন তাদের গোত্রের সাথে আরেকটা গোত্রের জায়গা-জমি নিয়ে বিশাল যুদ্ধ লেগেছিল। গাদ্দাফী নাকি সে সময় নিজে এসে সেটার সমাধান করে দিয়েছিল। অবশ্য এটা ব্যতিক্রম, তার জন্মস্থান বলেই হয়তো তিনি সেটাতে ইন্টারভেন করেছিলেন।

রাফিনঃ গাদ্দাফী লিবিয়ার অফিসিয়াল নামে পরিবর্তন এনেছিলেন না? এটা কতো সালে? নতুন লিবিয়ার অফিসিয়াল রাজনৈতিক মতাদর্শ কী হল?

ত্বোহাঃ গাদ্দাফী ইসলাম ও সমাজতন্ত্র মিশিয়ে একটা নতুন ধরনের দর্শন চালু করতে চেয়েছিলেন। তিনি একটা বইও লিখেছিলেন, কিতাবিল আখদার (দ্যা গ্রিন বুক)। তার আইডিয়া খারাপ ছিল না, কিন্তু সেটার যথাযথ প্রয়োগ কখনোই হয়নি। তিনি অনেকটা বেসিক ডেমোক্রেসি টাইপের একটা ব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিলেন, যেটার নাম দিয়েছিলেন জামাহিরিয়া – অর্থাৎ মাস পিপলের তন্ত্র। সেই অনুযায়ী লিবিয়ার নতুন নাম হলো দ্যা গ্রেট সোশ্যালিস্ট পিপল’স লিবিয়ান আরব জামাহিরিয়া। তিনি নিজে অফিশিয়ালি দেশের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে গিয়ে রেভোলিউশনারী লিডার খেতাব নিলেন। থিওরী অনুযায়ী রুট লেভেলে জনগণ মিটিং করে দেশ পরিচালনা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে সেগুলো উপরের দিকের কমিটির কাছে পাঠানোর কথা। মিটিংও হতো, রিপোর্টও পাঠানো হতো, তবে শেষ পর্যন্ত অবশ্য গাদ্দাফীর নিজের সিদ্ধান্তই বাস্তবায়িত হতো।

রাফিনঃ বোঝাই যাচ্ছে আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ধ্রুপদী সাম্যবাদী যে-চিন্তা আছে তার দ্বারা কিছুটা প্রভাবিত ছিলেন। তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে সফল হতে পারেন নি। আপনার কি মনে হয়, জামাহিরিয়া কেনো সত্যিকার অর্থে জনমানুষের তন্ত্র হয়ে উঠতে পারলো না (একনায়কতন্ত্র হল), এটা কি গাদ্দাফীর ব্যক্তিগত সমস্যা নাকি এর শেকড় লিবিয়ান সমাজেই ছিলো?

ত্বোহাঃ জামাহিরিয়া কতটা বাস্তবসম্মত, সেটা বোঝা যেতো, যদি সেটা সঠিকভাবে প্রয়োগের চেষ্টা থাকতো। কিন্তু গাদ্দাফী নিজেও সম্ভবত শেষ পর্যন্ত তার নীতিতে অটল থাকেন নি। তিনি একাধিক বার একাধিক বিষয়ে তার নীতি সম্পূর্ণ পরিবর্তন করেছেন। তার মধ্যে অনেকটা খামখেয়ালীপনা ছিল। আজ এক কথা বলতেন, দেখা গেল এক সপ্তাহ পর সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলতেন।

রাফিনঃ এটা কি শিশুসুলভ, শিশুদের ভেতর যেমন থাকে? মানে এই খামখেয়ালীপনাটা? নাকি অভিনয় ছিল?

ত্বোহাঃ অথবা নিরঙ্কুশ ক্ষমতা এবং চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ না থাকার ফলাফলও হতে পারে। কেউ যেহেতু কিছু বলার নেই, যা ইচ্ছা তাই বললাম!

রাফিনঃ মানে আমি তাঁর সততার ব্যাপারে জানতে চাচ্ছি! একনায়কতন্ত্রী শাসকদেরকে আমি মোটাদাগে দুটো ক্যাটেগরিতে ফেলি, একটা ক্যাটেগরির একনায়করা নিজেরাও জানেন না তাঁরা স্বৈরাচারী এবং নিজেদের ব্যাপারে তাঁদের উচ্চ ধারণা থাকে (এদেরকে শিশু বা পাগল বলা যায়), আরেকটা ক্যাটেগরির একনায়করা নিজেরাও জানেন তাঁরা স্বৈরাচারী (এঁরা ঠাণ্ডা মাথা জনগণের সাথে প্রতারণা করেন)। গাদ্দাফীকে, এই দুই ক্যাটেগরির, কোনটাতে ফেলা যায়?

ত্বোহাঃ এটা তো কঠিন প্রশ্ন হয়ে গেল। আমার মনে হয় একেবারে প্রথম দিকে গাদ্দাফী সত্যিকার অর্থেই জনকল্যানকামী বৈপ্লবিক নেতা ছিলেন। আশির দশকে তিনি দ্বিতীয় ক্যাটাগরির স্বৈরশাসকে পরিণত হয়েছিলেন। সে সময় লিবিয়াতে প্রচুর হত্যাকান্ড ঘটেছে। বিদ্রোহীদেরকে হত্যা করে রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের সাথে ঝুলিয়ে রাখার ঘটনাও তখন স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে যখন তার বিরুদ্ধে ফার্স্ট জেনারেশনের সব বিদ্রোহ মোটামুটি দমন হয়ে গেছে, তখন হয়তো তিনি প্রথম ক্যাটাগরির স্বৈরশাসকে পরিণত হয়েছিলেন। আমার ধারণা, এবং আরো কয়েকজন সাক্ষাৎকারেও এটা বলেছেন, ২০১১ সালে গাদ্দাফী বিশ্বাসই করতেন না যে মানুষ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে, মানুষের একটা অংশ তাকে চাইছে না।

রাফিনঃ খুব ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার! যা-হোক, তার শাসনামলের অন্যান্য প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। গাদ্দাফী চার দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলেন, আপনাকে যদি বলা হয় তাঁর শাসনামলের ভালো দিকগুলি বলতে, আপনি কোন কোন দিকগুলির কথা বলবেন?

ত্বোহাঃ এক নাম্বারে বলতে হবে নিরাপত্তার কথা। গাদ্দাফীর সময়ে আক্ষরিক অর্থেই ঘরের দরজা খোলা রেখে ঘুমানো যেত। আমাদের বাসার মেইন গেট বলা যায় ২৪ ঘন্টা খোলা থাকতো। কেউ বিনা অনুমতিতে ঢুকে যাবে – এটা কল্পনারও বাইরে ছিল। দরজায় কেউ নক করলে “কে” জিজ্ঞেস করার অভ্যাসটাও আমাদের তৈরি হয়নি সে সময়। মানুষ এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার সময় ভিড় ও তাপমাত্রা থেকে বাঁচার জন্য রাতের বেলা রওনা দিত। ৪০০-৫০০ কিলোমিটার পথ, ধূ-ধূ সাহারা, এর মধ্য দিয়েও বাংলাদেশীরাও রাত ৮টার সময় রওনা দিয়ে দেড়টা দুইটার সময় গন্তব্যে পৌঁছে যেত। কোনো ছিনতাই, অপহরণের ভয় ছিল না।

রাফিনঃ এরপর?

ত্বোহাঃ পুলিশ সার্ভিস বেশ অ্যাকটিভ ছিল। লিবিয়ানরা পুলিশকে বেশ ভয় পেতো। বিদেশীরাও কোনো প্রয়োজনে পুলিশের কাছে গেলে ভালো হেল্প পেত।

রাফিনঃ এগুলো তো নিরাপত্তার দিক ত্বোহা ভাই… নাগরিক অধিকার বলতে আমরা যা বুঝি, সেটা কেমন ছিল গাদ্দাফীর লিবিয়ায়?

ত্বোহাঃ নাগরিক অধিকার বা সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। যেরকম বলেছি, প্রথম এক-দেড় দশকে গাদ্দাফী সত্যিকার অর্থেই বিপ্লবী এবং জনকল্যাণমুখী শাসক ছিলেন। রাতারাতি লিবিয়ার জীবনযাত্রার মানে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। কিন্তু এরপর ধীরে ধীরে সব থেমে যেতে থাকে। আপনি ইন্টারনেটে বিভিন্ন প্রোপাগাণ্ডা সাইটে গাদ্দাফী আমলের ১০টি ফ্যাক্ট নামে একটা লিস্ট দেখবেন, যেখানে দাবি করা হয় লিবিয়ানরা কত সুযোগ-সুবিধা পেত। বাস্তবতা হচ্ছে, ঐ লিস্টের এক তৃতীয়াংশ পুরা মিথ্যা, এক তৃতীয়াংশ অনেক বেশি অতিরঞ্জিত, বাকি এক তৃতীয়াংশ সত্য। লিবিয়ানরা শান্তিতে ছিল, নিরাপদে ছিল – ট্রু। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে তাদের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। বিশেষ করে প্রায় একই রকম তেল সম্পদ সমৃদ্ধ অন্য গালফ কান্ট্রিগুলোর সাথে তুলনা করলে বলতে হবে লিবিয়ানরা ফকির ছিল। লিবিয়ার ইনফ্রাস্ট্রাকচার, রাস্তাঘাট – সব কিছুর অবস্থাই খারাপ ছিল। ২০০৪-০৫ এর দিকে সাইফ আল-ইসলাম কিছু সংস্কার করার আগ পর্যন্ত তো অধিকাংশ লিবিয়ানদের ঘরের ছাদ দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়াটাও একটা নিয়মিত দৃশ্য ছিল!

রাফিনঃ সাইফ আল-ইসলাম কে?

ত্বোহাঃ গাদ্দাফীর দ্বিতীয় ছেলে। তাকেই গাদ্দাফীর উত্তরসূরী মনে করা হতো। শেষ অন্তত ৮-১০ বছর তিনিই প্রকৃত পক্ষে দেশ চালাচ্ছিলেন। শেষের দিকে লিবিয়ার যে প্রো-ওয়েস্ট নীতি দেখা যাচ্ছিল, তিনিই ছিলেন তার উদ্যোক্তা।

রাফিনঃ মানে লিবিয়া যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ প্রকল্পের অংশীদার ছিল, যেটা বাংলাদেশে অনেকেই জানেন না, সেটার পেছনে তাহলে সাইফ আল-ইসলাম ছিলেন?

ত্বোহাঃ হ্যাঁ, গাদ্দাফী নিজেও হয়তো তার নীতি থেকে সরে এসেছিলেন। কিন্তু তার উপর সাইফের গভীর প্রভাব ছিল।

রাফিনঃ গাদ্দাফীর শাসনামলের খারাপ দিকগুলি সম্পর্কে কিছু বলেন।

ত্বোহাঃ গাদ্দাফী ভিন্নমতকে ভয়াবহভাবে দমন করতেন। যেটা আগেও বলেছি, আশির দশকে অনেককে হত্যা করে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হতো। বিদ্রোহীদের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হতো। তাদের পরিবারকে দেশছাড়া করা হতো। গাদ্দাফীর বিরোধীরা অধিকাংশই ইসলামপন্থী হওয়ায় গাদ্দাফী কোনো ধরনের ইসলামিক মুভমেন্ট সহ্য করতেন না। এমনকি, যেটা হয়তো বাংলাদেশে অনেকেই জানে না, গাদ্দাফীর সময় দাড়ি রাখা পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। আমরা সারা জীবন মসজিদের ইমামদেরকে দেখে এসেছি ক্লিন শেভড। দাড়ি রাখলেই সন্দেহ করা হতো ব্রাদারহুড বা অন্য কোনো ইসলামিক মুভমেন্টের সাথে জড়িত। আমাদের পরিচিত অনেক বাংলাদেশীও সে সময় দাড়ি রাখার অপরাধে পুলিশি হয়রানির শিকার হয়েছিল। ত্রিপলীর আবুসেলিম নামক কারাগারে, যেখানে মূলত পলিটিকাল বন্দীরা ছিল, যাদের অনেকেই ছিল আফগানিস্থান ফেরত ইসলামিক মৌলবাদী, বা অন্যান্য লোকাল ইসলামিক অ্যাকটিভিস্ট। সেখানে ১৯৯৬ সালে একসাথে ১২৭০ বন্দীকে হত্যা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। ২০১১ সালে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল, সর্বপ্রথম সেটার ডাক দিয়েছিল এবং প্রথম মিছিলটা কিন্তু বের করেছিল এই আবুসেলিম ম্যাসাকারের শিকারদের আত্মীয়-স্বজনরাই।

রাফিনঃ সিরিয়াতেও বাশার আল-আসাদের পিতা হাফিজ আল-আসাদের বিরুদ্ধে ঠিক এমনই একটা অভিযোগ আছে, যেমন হামা ম্যাসাকার, যেখানে মুসলিম ব্রাদারহুড হামা দখল করে নিলে সেটা পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে হাফিজ অপোজিশন-সিভিলিয়ান নির্বিশেষে একটা গণহত্যা চালিয়েছিলেন বলে ইসলামিস্টদেরকে পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।

ত্বোহাঃ লিবিয়ার ব্যাপারটি ঠিক অভিযোগ না। সে সময় সত্যি সত্যিই হত্যাকান্ড হয়েছিল। কয়েকশো মানুষ ডেফিনেটলি মারা গিয়েছিল, তাদের লিস্ট আছে। কিন্তু ১২৭০ কি না, সেটা পুরাপুরি নিশ্চিত না। ওটা একজনের বরাত দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উল্লেখ করেছিল, পরে সেই সোর্সটাই সবাই ব্যবহার করতে শুরু করে।

রাফিনঃ না, সিরিয়ার হামাতেও ডেফিনিটলি সিভিলিয়ান মারা গেছেন, বাংলাদেশেও যেমন জঙ্গি দমন অভিযানে অনেকসময় শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কিন্তু হাফিজপন্থীরা সেটাকে কোল্যাটারাল ড্যামেজ হিসেবে দ্যাখেন, আর ইসলামিস্টরা দ্যাখেন কোল্ডব্লাডেড ম্যাসাকার হিসেবে। একই ঘটনাকে একেকজন একেক পারস্পেকটিভ থেকে দ্যাখে, বিষয়টা অনেকটা এই রকম আর কি!

ত্বোহাঃ আমি আরেকটু ক্লিয়ার করি। আবু সেলিম ম্যাসাকারটা কোল্ড ব্লাডেড ম্যাসাকারই ছিল। সন্দেহ নাই, ওখানে আল-ক্বায়েদা সদস্যরা বন্দী ছিল, কিন্তু এর বাইরেও পলিটিকাল বন্দীও ছিল। এবং যতটুকু বর্ণনা পাওয়া যায়, প্রিজন রায়ট শেষ হয়ে যাওয়ার পরে যখন সব শান্ত হয়ে গিয়েছিল, তখন, পরদিন সকালে গ্রেনেড ফাটিয়ে এবং ব্রাশ ফায়ার করে সবাইকে হত্যা করা হয়।

রাফিনঃ ভয়াবহ! আচ্ছা, নৃশংসভাবে ভিন্নমত দমন করা ছাড়া, গাদ্দাফী শাসনামলের অন্যান্য খারাপ দিক সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলেন ত্বোহা ভাই। আমাদের সময় ফুরিয়ে আসছে, দ্রুত ২০১১র বিদ্রোহের প্রসঙ্গে যেতে হবে, একটু তাড়াতাড়ি করেন।

ত্বোহাঃ এটাই প্রধান। এছাড়া, অর্থনৈতিক অবস্থার কথা আগেই বলেছি। রাষ্ট্র হিসেবে লিবিয়া অনেক ধনী ছিল, কিন্তু মোটের উপর জনগণ দরিদ্র ছিল। শিক্ষাব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিল। দীর্ঘদিন পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল। এরপর যখন চালু হয়েছে, তখনও ক্লাস সেভেন থেকে এ বি সি ডি শেখানো হতো। চিকিৎসাব্যবস্থাও খারাপ ছিল। যাদের একটু টাকা-পয়সা ছিল, তারা কিছু হলেই তিউনিসিয়ায় গিয়ে চিকিৎসা করত। অফকোর্স, শিক্ষা-চিকিৎসা ফ্রি ছিল। কিন্তু মান ছিল খুবই খারাপ।

রাফিনঃ বোঝাই যাচ্ছে, গাদ্দাফী মিথের অনেকটাই স্রেফ গালগল্প। “শিক্ষা-চিকিৎসা ফ্রি” এই কথা শুনলেই তো বাংলাদেশে লোকে মনে করে দেশটা নির্ঘাৎ স্বর্গ জাতীয় কিছু একটা হবে। হা হা হা…

ত্বোহাঃ সেটাই।

রাফিনঃ আচ্ছা, ২০১১র বিদ্রোহের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটা প্রশ্ন করার লোভ সামলাতে পারছি না। ২০১২তে একটা ব্রিট-আমেরিকান পলিটিকাল স্যাটায়ার বা ব্ল্যাক কমেডি বেরোয়, নাম ছিল, দা ডিক্টেটর। আপনি সিনেমাটি দেখেছেন? এখানে যে ওয়াদিয়াহ রাষ্ট্রের অ্যাডমিরাল জেনারেল আলাদীনকে দ্যাখানো হয়, তাকে এমনভাবে প্রদর্শন করা হয়, যে বোঝাই যায় গাদ্দাফীকে মক করা হয়েছে। সিনেমায় অ্যাডমিরাল জেনারেল আলাদীনকে আল-ক্বায়েদার পৃষ্ঠপোষক ও ইজরায়েলের দুশমন হিসেবে পোর্ট্রে করা হয়। এবং তাঁকে কামুক ব্যক্তি হিসেবে দ্যাখানো হয়। যদি ধরে নেই, এখানে গাদ্দাফীকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে, তাহলে সিনেমাতে গাদ্দাফীকে যেভাবে পোর্ট্রে করা হয়েছে তা কি সত্য নাকি পশ্চিমা প্রোপাগাণ্ডা?

ত্বোহাঃ না, প্রপাগান্ডা। সাক্ষাৎকার দেওয়ার স্টাইল, খামখেয়ালিপনা, জাতিসংঘে বক্তৃতা দেয়া – এসবে গাদ্দাফীর সাথে মিল আছে। বাকিটুকু প্রোপাগাণ্ডা। তাছাড়া আমার যতদূর মনে পড়ে, ওটা শুধু গাদ্দাফী একা না, আরও কিছু ডিক্টেটরের সম্মিলিত চরিত্র ছিল। আর গাদ্দাফী বিশ্বের অনেক দেশে সন্ত্রাসীদের ফান্ডিং করেছিলেন, এটা সত্য। কিন্তু ইসলামিক মৌলবাদীদেরকে কখনোই প্রমোট করেন নি। ইন ফ্যাক্ট, আপনি জানেন কি না জানি না, গাদ্দাফী ১৯৯৮ সালে সর্বপ্রথম ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন, তাকে হত্যা চেষ্টাকারীদেরকে ফান্ডিং করার অভিযোগে।

রাফিনঃ হ্যাঁ, নির্মাতারা দাবি করেছেন সিনেমাটি একাধিক স্বৈরাচারীর চরিত্র দ্বারা প্রভাবিত, কিন্তু দেখেই গাদ্দাফীর কথা মনে হয়েছিলো আমার। আচ্ছা। আল-ক্বায়দার সাথে গাদ্দাফীর সম্পর্কের ব্যাপারটা যে প্রোপাগাণ্ডা তাতে অবশ্য আমার কোনো সন্দেহ নেই। এবার তাহলে সরাসরি ২০১১র বিদ্রোহে চলে যাই। এই বিদ্রোহের সূত্রপাত ঠিক কোথা থেকে হয়েছিলো? কী নিয়ে হয়েছিলো? নেতৃত্বে কারা ছিলেন?

ত্বোহাঃ এটা একটা মিক্সড বিদ্রোহ ছিল। বিদ্রোহের ডাক দিয়েছিল আবুসেলিম হত্যাকান্ডের শিকারদের আত্মীয়-স্বজনরা। তাদের অধিকাংশই ইসলামপন্থী, কেউ কেউ এক্সট্রিমিস্ট, আল-ক্বায়েদার সাথে সম্পর্কিত, বাকিরা নন-এক্সট্রিমিস্ট ইসলামিস্ট। আপনি যদি গাদ্দাফীর এবং সাইফের প্রথম দিকের ইন্টারভিউ এবং ভাষণগুলো দেখেন, দেখবেন বিদ্রোহের জন্য তারা সরাসরি আল-ক্বায়েদাকে দায়ী করছে। তারা কিছু আল-ক্বায়েদা নেতার নাম সহ অভিযোগ করেছিল, তখন আমরা বিশ্বাস করিনি, কিন্তু পরে দেখা গেছে সেই নেতারাই যুদ্ধের পর লিবিয়ার বিভিন্ন পদে বসে লিবিয়া শাসন করেছে, লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলকে আল-ক্বায়েদার অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। দ্বিতীয়ত, বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল। এটা আমরা মানতে চাই না, কিন্তু এটা বাস্তবতা। তারা ভুল আশ্বাসে হোক, আর যেভাবেই হোক, বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল। বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলের মানুষেরা। তৃতীয়ত, বিদেশীদের ভূমিকা। কোনো রাষ্ট্র আগে থেকেই প্ল্যান করে বিদ্রোহ ঘটিয়েছিল কি না, প্রমাণিত না, কিন্তু বিদ্রোহ শুরুর সাথে সাথে পশ্চিমা এবং আরব বিশ্ব একযোগে গাদ্দাফীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। আমরা আমেরিকাকে হাইলাইট করি, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে গাদ্দাফীর বিরুদ্ধে অ্যাকটিভ ভূমিকা নিয়েছিল ফ্রান্স এবং কাতার। ফ্রান্সের সারকোজিকে সেসময় লিবিয়ার উপর বিমান হামলা করতে রাজি করিয়েছিলেন ফরাশি ইহুদী দার্শনিক বার্নার্ড লেভি। আর কাতার ইসলামপন্থীদেরকে অর্থ-অস্ত্র সাহায্য দিয়ে, ট্রেনিং দিয়ে, ন্যাটোর সব খরচ বহন করার প্রতিশ্রুতিতে দিয়ে বিদ্রোহীদেরকে ফিল্ডে অপরাজেয় শক্তিতে রূপান্তরিত করেছিল।

রাফিনঃ ফরাশি দার্শনিক বেরনার-অঁরি লেভির কথা বলছেন আপনি? উনি তো ১৯৭১এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন! তখন তরুণ ছিলেন, কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে ছিলেন। পরে তাহলে এই ব্যক্তি ইম্পেরিয়ালিস্ট হয়ে গেছেন? মাই গুডনেস, এটা আমার জানা ছিল না! ২০১৪তেও বাংলাদেশে এসেছিলেন, ইউল্যাবে একটা বক্তব্যও দিয়েছেন। সেই বক্তব্যের একাংশ দৈনিক প্রথম আলো ছেপেছিলো, স্বপ্ন নিয়ে পাতায়, ২০১৬র মার্চে যেটা কাকতালীয়ভাবে আমি পড়েও ফেলেছিলাম।

ত্বোহাঃ হ্যাঁ। লিবিয়ার বিদ্রোহটাকে আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়ার ব্যাপারে একক ব্যক্তি হিসেবে তার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি ছিল।

রাফিনঃ প্রথম আলো এই ধরণের লোককে বাংলাদেশের তরুণদের সামনে আইকন হিসেবে রিপ্রেজেন্ট করে তাহলে… যা কিছু ভালো তার সঙ্গে প্রথম আলো… হা হা হা!

ত্বোহাঃ হা হা হা!

রাফিনঃ আচ্ছা, সৌদি আরব ও কাতারসহ বিভিন্ন গালফ কান্ট্রি, এবং তুরস্কের ভূমিকা কী ছিলো? ক্বাতারের ব্যাপারটা অবশ্য একটু আগে বলেছেন কিছুটা। একটু বিস্তারিত বলেন, বিশেষত আল-জাজিরা লিবিয়ায় কী রোল প্লে করেছে, এটা জানার ব্যাপারে বিশেষ কৌতূহল আছে আমার!

ত্বোহাঃ আল-জাজিরা পুরো যুদ্ধের সময় নির্লজ্জভাবে প্রপাগান্ডা চালিয়ে গেছ। উদাহরণ দেই, কোনো একটা শহরে যুদ্ধ চলছে, আল-জাজিরা মাত্র একজন বিদ্রোহী যোদ্ধার সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ব্রেকিং নিউজ দিয়ে বসতো যে, ঐ শহরটা দখল হয়ে গেছে, এলাকাবাসী দলে দলে বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দিচ্ছে … ইত্যাদি। সেই তুলনায় বিবিসি, সিএনএন হাজারগুণে ভালো রিপোর্টিং করেছে। আল-জাজিরা ছিল লিবিয়ান স্টেট টিভির বিপরীত ভার্সন। দুই চ্যানেল দুই পক্ষে প্রোপাগাণ্ডা চালিয়েছে। জাজিরার সাথে অবশ্য আল-আরাবীয়াও ছিল। আমাদের শহর সিরতের কথা বলি। সিরত গাদ্দাফীর জন্মস্থান, তার সমর্থকদের স্ট্রংহোল্ড। অথচ সেখানেও আল-জাজিরা দাবি করেছিল শহরটা দখল হয়ে গেছে। আমরা দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে নিশ্চিত হতে হয়েছে যে, আসলে কিছুই হয়নি। যুদ্ধ চলাকালীন সময় তুরস্কের ভূমিকা মোটামুটি নিরপেক্ষ ছিল। তারা সমঝোতার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আবার ন্যাটোর সদস্য হিসেবে যুদ্ধজাহাজও পাঠিয়ৈছিল। তবে যুদ্ধের পরে, কাতারের ভূমিকাটা তুরস্ক নিয়ে নিয়েছিল। যেসব ইসলামিস্ট এক্সট্রিমিস্টরা কাতারের সাহায্য এবং সমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, যেমন ধরেন, আব্দুল হাকিম বেলহাজ, যে আল-ক্বায়েদার অঙ্গসংগঠন লিবিয়ান ইসলামিক ফাইটিং গ্রুপের নেতা ছিল এবং আফগান যুদ্ধে আল-ক্বায়েদার হয়ে অংশ নিয়েছিল, যুদ্ধের পর কাতারের পরিবর্তে তুরস্কের সাথে তাদের বেশি সম্পর্ক দেখা গেছে।

রাফিনঃ এখানে একটু পেছনের প্রসঙ্গ টানতে হচ্ছে আমাকে। লিবিয়া আগ্রাসনে হিলারি ক্লিনটনের একটা ভূমিকা ছিল। এবং মার্কিন নির্বাচনে সন্দেহাতীতভাবে এর প্রভাব পড়েছে। ট্রাম্প জেতার পেছনে নিশ্চয়ই বহু কারণ আছে। কিন্তু হিলারি যে লিবিয়া আগ্রাসনে ভূমিকা রেখেছিলেন, এটা তাঁকে যথেষ্ট পরিমাণে বিতর্কিত করেছিলো। একটা ছোটো ডকুমেন্টরি দেখেছিলাম ইউটিউবে, কোনো একটা ইন্টারভিউয়ে গাদ্দাফী হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ আসছে, তো হিলারি সিজারের দম্ভ নিয়ে হাসতে হাসতে বলছেন, “উই কেইম, উই স, এন্ড হি ডাইড”…। এই প্রসঙ্গে আমাদেরকে কিছু বলেন, ত্বোহা ভাই।

ত্বোহাঃ আমেরিকার ভূমিকা তো অবশ্যই ছিল। বর্তমান বিশ্বের লিডার তো তারাই, প্রতিটা ব্যাপারেই তাদের ভূমিকা থাকবে – এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হিলারির বক্তব্যটা অতিরঞ্জিত – তিনি ক্রেডিট নিয়ে নিজের প্রোফাইল সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলেন, যদিও পরে সেটাই হিতে বিপরীত হয়েছে। যেটা আমি আগেও বলেছি, লিবিয়া যুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকা কম ছিল। এটা আপনি গাদ্দাফীর ভাষণগুলো দেখলেও বুঝতে পারবেন। গাদ্দাফীর প্রতিটা ভাষণে প্রচন্ড ক্ষোভ থাকতো সারকোজি এবং কাতারের আমীরের বিরুদ্ধে, কিছুটা ডেভিড ক্যামেরনের বিরুদ্ধে। আর হতাশা থাকতো বারলুসকনি, ব্লেয়ার ও এরদোগানকে নিয়ে – কারণ এদের কাছে গাদ্দাফী নিজের প্রতি সমর্থন আশা করেছিলেন, কিন্তু সেটা পাননি। ওবামা বা আমেরিকার বিরুদ্ধে খুবই কম অভিযোগ থাকত। আর গাদ্দাফীকে হত্যার ব্যাপারে সরাসরি কোনো রাষ্ট্র দায়ী থাকলে, সেটাও ফ্রান্স। তাদের বিমানই গাদ্দাফীর গাড়িবহরে হামলা করেছিল।

রাফিনঃ হ্যাঁ, আমি উইলিয়াম ব্লুমের বইয়ে পড়েছি, গাদ্দাফী নাকি বারাক ওবামার কাছে একটা চিঠিও লিখেছিলেন সাহায্য প্রার্থনা করে!!!

ত্বোহাঃ অথচ এই বিষয়গুলো কিন্তু আমরা মানতে রাজি না। আমাদের ধারণা পুরা ব্যাপারটা আমেরিকার প্ল্যান এবং আমেরিকার অপারেশন। যুদ্ধের পরেও যদি দেখেন, আমেরিকা কোনো ভূমিকা পালন করছে না। লিবিয়ার একাধিক ব্যক্তি এবং পার্টি শতশত মিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করেছে লবিস্ট ফার্মগুলোর পেছনে, তারপরেও আমেরিকাকে লিবিয়ার ব্যাপারে ইনভল্ভ করাতে পারছে না। এখন পর্যন্ত ফ্রান্স, ইতালি সহ আরব দেশগুলোই এখানে মূল খেলোয়াড়।

রাফিনঃ আচ্ছা, একটু আগে বলছিলেন, লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলো। ঠিক পূর্বাঞ্চলই কেনো? এটা কি কাকতালীয়… নাকি… ঐতিহাসিক কোনো কারণ…?

ত্বোহাঃ ঐতিহাসিকভাবেই পূর্বাঞ্চলের মানুষ বিদ্রোহী ছিল। ওমর আল-মুখতারও পূর্বাঞ্চলের। তাছাড়া পূর্বাঞ্চলের দারনা শহরটা দীর্ঘদিন আল-ক্বায়েদাপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। আবুসেলিমে নিহতদের অধিকাংশও ঐ এলকার। সব মিলিয়েই। তবে শুধু পূর্বাঞ্চল না, লিবিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর পশ্চিমের মিসরাতা যুদ্ধে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। গাদ্দাফীকে ওরাই ধরেছিল।

রাফিনঃ লিবিয়ায় জিহাদী গোষ্ঠী তো একটা না সম্ভবত। একাধিক। গোষ্ঠীগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে বলেন… তাদের নেতৃত্ব সম্পর্কেও। বিদ্রোহীদের মধ্যে কোনো নন-জিহাদী ফ্যাকশন কি আছে? নাকি লিবিয়ায় বিদ্রোহী আর জিহাদী সমার্থক শব্দ?

ত্বোহাঃ না, বিদ্রোহী এবং জিহাদী সমার্থক না। বিদ্রোহীদের মধ্যে সবাই ছিল – ইসলামিস্ট, নন ইসলামিস্ট, সেকুলার – সবাই। তবে ইসলামিস্টরা তাদের কানেকশনের কারণে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল। জিহাদী গ্রুপগুলো নামে ভিন্ন ভিন্ন হলেও মূলত সবাই একই উৎস থেকে এসেছেঃ আল-ক্বায়েদা। সিনিয়র নেতাদের অধিকাংশই আফগান ফেরত, অন্তত দুইজন আছে গুয়ানতানামো কারাগারফেরত। নতুন যারা আছে, তাদের অধিকাংশই ইরাকে আমেরিকানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। ফেরার পরে গাদ্দাফীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল। জিহাদী নেতাদের একটা বড় অংশ গাদ্দাফীর সময় আবুসেলিম কারাগারে বন্দী ছিল। গাদ্দাফীর পতনের পর জেল ভেঙ্গে বেরিয়ে এসেছে। আল-ক্বায়েদার বর্তমান ডিসেন্ট্রালাইজড নীতির কারণে এরা এখন আর কেউ সরাসরি আল-ক্বায়েদার অধীনস্থ না। কেউ একিউআইএম (আলক্বায়েদা ইন ইসলামিক মাগরেব) এর সদস্য, কেউ লোকাল আনসার শারিয়ার সদস্য। কিন্তু এই সবগুলো গ্রুপই জাওয়াহিরির প্রতি অনুগত। বিভিন্ন স্যাংশনে পড়লে গ্রুপগুলো নাম চেঞ্চ করে নতুন নাম গঠন করে – আনসার শারীয়া, মাজলেশ শূরা মুজাহিদীন বেনগাজী, বেনগাজী ডিফেন্স ব্রিগেড। কিন্তু আসলে একই, মানে লীডারশিপ একই। এবং এদের একটা ফ্র্যাকশনই পরে আইএস সৃষ্টি করেছে। শুধুমাত্র দারনাতে আইএসের সাথে আল-ক্বায়েদার ক্ল্যাশ হয়েছে। কিন্তু এর বাইরে সিরতে এবং বেনগাজীতে আইএস আল-ক্বায়েদা একত্রে কাজ করেছে।

রাফিনঃ বিদ্রোহীদের ভেতর নন-ইসলামিস্ট বা সেকুলার এলিমেন্ট ছিলো? খুব ইন্টারেস্টিং তো! এই এলিমেন্টগুলোর কোনো প্রতিনিধি বা সংগঠনের নাম…? মানে নন-ইসলামিস্ট বা সেকুলাররা নিশ্চয়ই আল-ক্বায়েদার নেতৃত্বে যুদ্ধ করবে না! যেমন সিরিয়ায় ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (এফএসএ) ছিলো…

ত্বোহাঃ আমি সম্ভবত ব্যাপারটা বোঝাতে পারিনি। যুদ্ধে সব পক্ষই ছিল। কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল ইসলামিস্টরা এবং বিদ্রোহটা শুরুও করেছে ইসলামিস্টরা, যাদের মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আল-ক্বায়েদা নেতা ছিল। কিন্তু আল-ক্বায়েদার নেতৃত্বে যুদ্ধ হয়েছে এটা বলা যাবে না। বিদ্রোহীদের যে অফিশিয়াল প্রতিনিধি, এনটিসি, তাদের নেতা মোস্তফা আব্দুল জলিল ইসলামিস্ট হলেও বাকি সদস্যদের অধিকাংশই ছিল নন-ইসলামিস্ট। অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরীল ছিলেন সেকুলার। যুদ্ধের মাঝামাঝিতে যোগ দেওয়া জেনারেল হাফতার শুধু সেকুলার না, তিনি এক সময় সিআইএর এজেন্টও ছিলেন, যদিও বর্তমানে তাকে রাশিয়াঘেঁষাই মনে হচ্ছে। অর্থাৎ সবাই মিলেই যুদ্ধ করেছে, কারণ সবার টার্গেট একটাই ছিল – গাদ্দাফীকে হটাতে হবে। কিন্তু তখনও দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। যেমন কাতার যে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার এবং ২০০০ টন অস্ত্র দিয়েছিল, সেটা তারা অফিশিয়াল প্রতিনিধি এনটিসিকে এড়িয়ে সরাসরি ইসলামিস্টদেরকে দিয়েছিল। সেটা নিয়ে তখন দুই পক্ষের মধ্যে বেশ বাদানুবাদও হয়েছিল।

রাফিনঃ আচ্ছা, এবার বুঝলাম। দায়েশ, অর্থাৎ আইএস, লিবিয়ায় ঠিক কখন ঢুকলো? কেউ কি তাদেরকে লিবিয়ায় ঢুকতে সাহায্য করেছে?

ত্বোহাঃ লিবিয়ার সিরত ছিল রাক্কা এবং মৌসুলের পর দায়েশের তৃতীয় বৃহত্তম ঘাঁটি। সেখানে তাদেরকে পরাজিত করার পর গত এক বছর ধরে তদন্ত হয়েছে, এবং তদন্তের পর অ্যাটর্নি জেনারেলের একটা বক্তব্য আমি কোট করি। তিনি বলেছেন, “দায়েশকে ফান্ডিং করেছি আমরা, অর্থাৎ লিবিয়ান সরকার।” ব্যাপারটা এরকম, আনসার শারীয়া, যারা বেনগাজীতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে হত্যা করেছিল, তারা ছিল আলক্বায়েদার লিবিয়া শাখা। কিন্তু যেহেতু লিবিয়াতে ইসলামিস্ট সরকার ক্ষমতায় ছিল, তাই তাদেরকে একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অফিশিয়াল নিরাপত্তা রক্ষী বাহিনী হিসেবে বেতন, এবং তাদের এলাকায় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য বাজেট দেওয়া হতো। সেই অর্থ এবং টাকা পয়সা নিয়েই তারা দলেবলে আইএসে যোগ দিয়েছে। সবাই না অবশ্য, একটা বড় অংশ আইএসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে, বাকিরা বাধা দেয়নি। এটা ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের দিকের ঘটনা। এরপর তারা ধীরে ধীরে পুরা লিবিয়াতে বিস্তার লাভ করে। আমাদের শহরে, অর্থাৎ সিরতে তারা অফিশিয়ালি আত্মপ্রকাশ করে ২০১৫ সালের মার্চে। পরে দেখা গেছে অন্তত ২০১৪ সালের ডিসেম্বর থেকেই আনসার শারীয়ার অধীনে সেখানে ছিল। আনসার শারিয়ার নেতারা তুরস্ক হয়ে সিরিয়াতে গিয়ে আদনানীর সাথে দেখা করে বায়াত পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তারপরেও এই পুরো সময়টা তারা সিরতে ছিল লিবিয়ার সরকারের অনুমোদিত বৈধ নিরাপত্তা রক্ষী বাহিনী হিসেবেই। ফান্ডিং-এর একটা বড় অংশ পেয়েছে এসেছিল সরাসরি আইএসের সেন্টার থেকে। আর আরেকটা বড়ো অংশ তারা পেয়েছিল লিবিয়ার ব্যাংকগুলো ডাকাতি করে।

রাফিনঃ আদনানী?

ত্বোহাঃ দায়েশের অফিসিয়াল মুখপাত্র।

রাফিনঃ পরে কী হল? সিরত কিভাবে দায়েশের হাত থেকে মুক্ত হল? এবং কত সালে?

ত্বোহাঃ আইএস প্রায় এক বছর সিরত শাসন করেছে। পরে ২০১৬ সালে যখন জাতিসংঘের মধ্যস্থায় লিবিয়াতে নতুন সরকার গঠিত হয়, তারা আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্যোগ নেয়। যুদ্ধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে মিসরাতার যোদ্ধারা। প্রায় সাত মাস যুদ্ধ হয়, ৭০০-এর বেশি সরকারপন্থী যোদ্ধা শহিদ হয়। আইএসেরও প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার জঙ্গী মারা যায়, যাদের অনেকেই আত্মঘাতী হামলা করে। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় থেকে লিবিয়ান সরকারের রিকোয়েস্টে আমেরিকা আইএসের উপর বিমান হামলা শুরু করে। প্রায় ৫০০টা অ্যাটাক করেছিল তারা। ওটা সরকারপন্থী যোদ্ধাদের ক্যাজুয়ালিটি লিমিটেড করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

রাফিনঃ আচ্ছা, এই মুহূর্তে লিবিয়া কী অখণ্ড আছে? মানে শাসনতান্ত্রিক অর্থে? নাকি দেশটার একেক অংশ একেক সরকার চালাচ্ছে?

ত্বোহাঃ না, ত্রিপলী সহ পশ্চিম অংশ চালাচ্ছে জাতিসংঘ সমর্থিত সরকার। আর পূর্বের অংশ চালাচ্ছে জেনারেল হাফতার সমর্থিত সরকার। দক্ষিণ দিক অফিশিয়ালি ত্রিপলীর অধীনে, কিন্তু বাস্তবে হাফতারের অধীনে। ভীষণ জটিল একটা পরিস্থিতি। অর্থনৈতিকভাবে দেশটা একটাই। অর্থাৎ তেল উৎপাদন, রিভিনিউ সব ত্রিপলী কেন্দ্রিক, কিন্তু প্রশাসণ এবং এরিয়ার নিয়ন্ত্রণে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ।

রাফিনঃ জেনারেল হাফতার কী-পন্থী? ইসলামিস্ট? না সেকুলার?

ত্বোহাঃ হাফতার কঠোর অ্যান্টি-ইসলামিস্ট। আন্তর্জাতিকভাবে আরব আমিরাত এবং মিসর বলয়ের। সম্প্রতি রাশিয়ার সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।

রাফিনঃ আচ্ছা। এক কথায় উত্তর দিনঃ লিবিয়ান বিদ্রোহ কি সফল হয়েছে নাকি ব্যর্থ হয়েছে? অন্তত এই মুহূর্তে কী মনে হচ্ছে আপনার?

ত্বোহাঃ চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। লিবিয়া ধ্বংস হয়ে গেছে। অর্থনীতি, সোশ্যাল ফ্যাব্রিক – সব ধ্বংস হয়ে গেছে। স্বয়ং গাদ্দাফীকে যদি কবর থেকে উঠিয়ে এনে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তিনিও সম্ভবত লিবিয়াকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারবেন না। বিদ্রোহের সময় যারা বিদ্রোহীদেরকে সমর্থন দিয়েছিল, তাদের একটা বড় অংশও এখন অনুতপ্ত। অবশ্য গাদ্দাফীর হাতে যারা মার গিয়েছিল, তাদের আত্মীয়-স্বজনরা বাদে।

রাফিনঃ আপনাকে যদি বলা হয়, কেনো বিদ্রোহ ব্যর্থ হল, আপনি কী কী কারণ বলবেন?

ত্বোহাঃ যোগ্য নেতৃত্বের অভাব একটা বড় কারণ ছিল। নেতৃত্ব ছাড়া যুদ্ধ করা যায়, সরকারের পতন ঘটানো যায়, কিন্তু দেশ পরিচালনা কর যায় না। যুদ্ধের সময়টা সহজ, এর পরবর্তী সময়টা খুবই ক্রিটিকাল। লিবিয়ানদের মধ্যে যদি এমন একজন নেতা থাকত, যার কথায় মানুষ অস্ত্র জমা দিয়ে দিবে, তাহলে এই বিশৃঙ্খলাটা হতো না। নিয়মিত সেনাবাহিনী না থাকা এবং মানুষের হাতে হাতে অস্ত্র থাকাটা লিবিয়ার যেকোনো সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ করে রেখেছে। তাছাড়া বিদেশী শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপও একটা বড় কারণ। প্রতিটা পরাশক্তি চাইছে তাদের পছন্দের গ্রুপগুলো যতো বেশি সম্ভব এলাকার নিয়ন্ত্রণে থাকুক। ফলে কন্টিনিউয়াস সিভিল ওয়ার চলছে। রিকন্সিলিয়েশনের অভাব আরেকটা বড় কারণ ছিল। লিবিয়ার সমাজ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। গাদ্দাফীপন্থী এবং গাদ্দাফী বিরোধী। যুদ্ধের শুরুতে গাদ্দাফী যেরকম করেছে, যুদ্ধের শেষে শুধুমাত্র গাদ্দাফী পন্থী হওয়ার অপরাধে বিদ্রোহীরা কয়েকটা শহর ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করেছিল। পরবর্তীতে পলিটিকাল আইসোলেশন ল বলে একটা আইন পাশ করেছিল তারা। সেখানে গাদ্দাফীর অধীনে জীবনে কোনো এক সময় কোনো পদে ছিল এরকম সবাইকে ১০ বছরের জন্য সরকারি যেকোনো পদ থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এতো ঘৃণা এবং বিভাজন নিয়ে তো একটা জাতির পকষে মাথা তুলে দঁড়ানো সম্ভব না!

রাফিনঃ ত্বোহা ভাই, শেষ প্রশ্ন… লিবিয়ার ভবিষ্যৎ কী?

ত্বোহাঃ যেহেতু আমি লিবিয়াতে আছি, আমি প্রতি মুহূর্তেই আশা করি, লিবিয়ার পরিস্থিতর উন্নতি হোক। বিবাদমান পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা হোক। কিন্তু যদি বাস্তবতার দিকে তাকাই, তাহলে লিবিয়ার ভবিষ্যত খুবই অন্ধকার। এতো ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে এই জাতি, অর্থনীতি এতো বেশি ভেঙ্গে পড়েছে, এবং বিদেশীরা এতো বেশি ইনভলভ্ড হয়ে গেছে, এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো আসলে খুবই কঠিন। আমার মনে হয় না, একটা নতুন জেনারেশন এসে একটা প্রতিবিল্পব করার আগ পর্যন্ত, অথবা বিশ্বরাজনীতি ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তিত হওয়ার আগ পর্যন্ত লিবিয়ার অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হবে। এভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়েই ধুঁকে ধুঁকে দেশটা এগিয়ে যেতে থাকবে। অথবা, বলা ভালো, পিছিয়ে যেতে থাকবে।

রাফিনঃ আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

ত্বোহাঃ আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

 

পরিচয়: মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা একজন প্রবাসী বাংলাদেশী প্রকৌশলী। জন্মের পরপরই ১৯৯০এ মাবাবার সাথে লিবিয়াতে গেছেন। সেই থেকে লিবিয়াতেই। সিরত ইউনিভার্সিটিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে ত্রিপলীতে আছেন। চাকরি করছেন সেখানকার আল-নাহার কোম্পানীতে। লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ তিনি খুবই কাছ থেকে দেখেছেন। গাদ্দাফীর মৃত্যুর তিন দিন আগ পর্যন্ত প্রচন্ড যুদ্ধের মধ্য দিয়েও তিনি গাদ্দাফীর জন্মস্থান সিরতেই ছিলেন। পরে বিদ্রোহীদের সহায়তায় সেখান থেকে বের হন। যুদ্ধের পরেও সিরতে ছিলেন, কিন্তু ২০১৫তে দায়েশের হাতে শহরটির পতন হলে সিরত ছেড়ে ত্রিপলিতে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। যুদ্ধকে কাছ থেকে দেখার বাস্তব অভিজ্ঞতাই তাকে রাজনীতিসচেতন করে তুলেছে। লিবিয়া বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা এবং বিশ্লেষণ নিয়মিত তুলে ধরেন ফেসবুকে তার ফ্রেন্ড ও ফলোয়ারদের কাছে। এছাড়াও নিয়মিত লেখালেখি করেন ইন্টারনেটে জনপ্রিয় প্লাটফর্ম রোর বাংলায়।

সাক্ষাৎকারগ্রহীতাঃ ইরফানুর রহমান রাফিন

নোটঃ ২১ এপ্রিল ২০১৭ থেকে ২৬ এপ্রিল ২০১৭ পর্যন্ত মেসেঞ্জারের মাধ্যমে সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়েছে। সাক্ষাৎকারদাতা ত্রিপলীতে ছিলেন আর সাক্ষাৎকারগ্রহীতা ছিলেন ঢাকায়। প্রকাশ করার আগে সাক্ষাৎকারদাতাকে দেখিয়ে নেয়া হয়েছে।

One thought on “‘লিবিয়ার শতবর্ষের নির্জনতা’ : মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার সাক্ষাৎকার”

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান