ঈদ এক বছর পরপরই আসে। বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে একটা ঈদ আসে দুই মাস পরে,আরেকটা আসে দশমাস পরে। কিন্তু আমাদের জন্য এবার ঈদ এসেছে দুই বছর পরে। কারণ গত বছরের কোন ঈদই আমরা ঠিকভাবে পালন করতে পারিনি। রোযার ঈদের সময় আমরা ছিলাম চারদিকে বিদ্রোহী সৈন্যদের দ্বারা অবরুদ্ধ শহরে। আর কুরবানীর ঈদের সময় ছিলাম মাত্র যুদ্ধ কাটিয়ে উঠা বিদ্ধস্ত শহরে। জীবনে প্রথমবারের মতো কুরবানী ছাড়াই ঈদ উদযাপন করতে বাধ্য হয়েছিলাম আমরা।
২২ শে অক্টোবর, শনিবার। সকাল দশটার দিকে আমরা খামসিন থেকে বের হয়ে সিরতের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। সাথে প্রচুর পরিমাণ খাবার-দাবার। যাচ্ছি একটা ট্রাকের পেছনে চড়ে। খামসিনের চেক পয়েন্ট থেকে বিদ্রোহীরা এই ট্রাকওয়ালাকে রিকোয়েস্ট করে আমাদেরকে উঠিয়ে দিয়েছে। রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় দেখলাম যুদ্ধের গাড়ি তেমন নেই, কিন্তু সাধারণ পিকআপে আর ট্রাকে করে মানুষ দামী দামী গাড়ি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন সহ দামী দামী জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে বিভিন্ন দোকানপাট এবং বড়লোকদের বাড়ি থেকে লুটপাট করা জিনিস এগুলো।
উদ্ধার হওয়ার পর আমাদেরকে বেশিক্ষণ রাস্তায় অপেক্ষা করতে হল না। সেই দাড়ি-টুপি এবং চশমা ওয়ালা বৃদ্ধ আমাদেরকে এক যোদ্ধার গাড়িতে তুলে দিয়ে নিজে পেছন পেছন আসতে লাগল। সেই যোদ্ধা গাড়িতে উঠেই প্রথমে আমাদেরকে বলল, গুল গাদ্দাফী ক্যাল্ব। অর্থাৎ, বল গাদ্দাফী কুত্তা। আমরা সবাই-ই সম্মতিসূচক একটা হাসি দিলাম, কিন্তু প্রথমে কেউই উচ্চারণ করলাম না। গাদ্দাফীর এই মুহূর্তের নীতি খারাপ, কিন্তু জন্মের পর থেকে তো তার দেশেই খেয়ে পরে বড় হচ্ছি, এতো সহজে তাকে এভাবে গালি দেই কিভাবে?
সারাদিন প্রচন্ড যুদ্ধ চলল। সন্ধ্যার সময় যখন গোলাগুলির আওয়াজ কমে এল, তখন আমাদের বাসা থেকে ছয়-সাতশো মিটার দূরে অবস্থিত রমজান আংকেলদের এলাকা থেকে হঠাৎ আল্লাহু আকবার শ্লোগান শোনা যেতে লাগল। আমাদের বুকের মাঝে রক্ত যেন ছলকে উঠল। তারমানে কি বিদ্রোহীরা আরও এগিয়ে আসছে? যুদ্ধ কি শেষ হয়ে আসছে? মাগরিবের ওয়াক্তের প্রায় বিশ মিনিট পরে যুদ্ধ পুরাপুরি থামল এবং ঘরে আসার পর দীর্ঘ তিন সপ্তাহের মধ্যে এই দিন আমরা প্রথম কোন আজান শুনতে পেলাম। মাগরিব এবং এশার মধ্যবর্তী সময়টাতেও আল্লাহু আকবার শ্লোগান শোনা যেতে লাগল। বিদ্রোহীদের দুঃসাহস দেখে আমরা হতবাক হয়ে গেলাম। কারণ আমাদের বাসার ঠিক পেছনেই তখনও গাদ্দাফী বাহিনী অবস্থান করছিল।
৩০ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার। সকাল নয়টার দিকে আমরা শামীমদের বাসা থেকে বেরিয়ে আমাদের বাসার দিকে যাত্রা শুরু করলাম। রক্বম ওয়াহেদে অবস্থিত ন্যাটোর বোমায় বিদ্ধস্ত একটা স্কুল, বিদ্রোহীদের মিসাইলে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ওয়াহদা ব্যাংক এবং মেইন রোডের দুপাশে লুটপাট হওয়া দোকানপাটগুলো দেখতে দেখতে আমরা এগোচ্ছিলাম। রাস্তাগুলো গাড়ি চলাচলের অযোগ্য। রকেট পড়ে জায়গায় জায়গায় রাস্তা গর্ত হয়ে আছে। হাইডলার রোড থেকে শুরু করে রক্বম ওয়াহেদ এবং রক্বম এতনীনের সামনের মেইড রোড এক থেকে দেড় ফিট পানির নিচে তলিয়ে আছে। সম্ভবত গোলার আঘাতে জায়গায় জায়গায় ফেটে যাওয়া পানির পাইপের কারণেই এ অবস্থা। বোঝা গেল, রক্বম তালাতা এবং সাওয়াবার দিকেই এখনও যা কিছু মানুষের বসবাস আছে, রক্বম ওয়াহেদ প্রায় ফাঁকা। আর রক্বম এতনীন যেন একটা নির্জন ভূতুড়ে নগরীর কংকাল। পুরো রক্বম এতনীনে মাত্র একটা ফ্যামিলি ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলাম না।
‘আশরিনে আমাদের দিনগুলো মোটামুটি ভালোই কাটছিল। প্রথম দিন আমাদেরকে বেশ ভালোই আপ্যায়ন করল। দুপুরে একটা খারুফ (ভেড়া) জবাই করে মাকরোনা দিয়ে খেতে দিল। বিকেলে আবার খুবজা দিয়ে চা। দিনের বেলাটা আমাদের ভালোই কাটল। বাসা থেকেই সমুদ্র দেখা যায়। বিকেলের দিকে বাচ্চাকাচ্চা সহ আমরা সবাই সমুদ্রে গেলাম। যুদ্ধের কোন চিহ্নও এই এলাকাতে নেই। ন্যাটোর ফাইটারও এদিকে আসে না। শুধু অ্যাপাচি হেলিকপ্টারগুলো খুব নিচে দিয়ে উড়ে, একেবারে পরিষ্কার দেখা যায়।
শুক্রবারের পুরো দুপুর এবং বিকেল আমরা না খেয়ে কাটালাম। মাস্তুরার (বাড়িওয়ালা কামালের স্ত্রী) মায়েরা এমনিতেই গরীব, তাছাড়া গত চার মাস ধরে তাদের উপর বসে বসে খাচ্ছিল মাস্তুরার মামাতো ভাই আ’ত হারাগাদের একটা বিশাল পরিবার এবং তাদের প্রতিবেশী বু’সেফীদের পরিবার, যারা মিসরাতা যুদ্ধের সময় মিসরাতা থেকে সিরতে পালিয়ে এসেছিল। সন্ধ্যার সময় খাবার দিল, কিন্তু তা নিতান্তই অপর্যাপ্ত। শুধুমাত্র কুসকুসি, কোন মাংস বা তরকারি ছাড়াই। অবশ্য কারেন্ট না থাকার কারণে কারো বাসায় মাংস বা তরকারি আশা করাটাও বোকামী। সারাদিন ধরে শহরের ভেতর থেকে যুদ্ধের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল এবং শব্দ শুনেই বুঝা যাচ্ছিল আগের দিনের থেকেও ভয়াবহ যুদ্ধ হচ্ছে। সন্ধ্যার সাথে সাথে আওয়াজ শুনে বুঝা গেল বিদ্রোহীরা যুদ্ধ শেষ করে ফিরে আসছে। সামনের রাস্তা দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় অনেক মানুষের “আল্লাহু আকবার” শ্লোগান আমাদের কানে এল।
১৬ই সেপ্টেম্বর, শুক্রবার। আগের দিন রাতের বেলা ছাড়াছাড়া ভাবে ঘুম হয়েছিল, তবুও খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল। নাস্তা করে এলাকাটা দেখতে বের হয়ে আবিষ্কার করলাম পুরো এলাকা ফাঁকা। রাতে রাতেই বেশির ভাগ মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। মেইন রোডে গিয়ে দেখি রাস্তার দুপাশের গাছগুলো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে উপড়ে পড়ে আছে। দুপাশের দোকানগুলোর দরজা, দেয়াল ভেঙ্গে রাস্তায় পড়ে আছে। কাঁচের টুকরার জন্য রাস্তায় হাঁটা যাচ্ছে না। এলাকার প্রায় প্রতিটা দোতলা-তিনতলার বাড়ির দেয়ালে কয়েকটা করে গুলির ছিদ্র। আশেপাশের বাঙ্গালিদের বাসায় গিয়েও একটু খোঁজ-খবর নিলাম। সৌরভরা, মুক্তারা, হীরণ ভাইরা – সবাই-ই ভালো আছে।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আটমাস ধরে পুরো লিবিয়া জুড়ে যত যুদ্ধ হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধটি হয়েছে গাদ্দাফীর জন্মস্থান সিরতে। সিরতের মধ্যে যে এলাকাটিতে সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো এক মাস পাঁচদিন ব্যাপী যে এলাকাটিতে তুমুল যুদ্ধ চলেছে এবং যে এলাকাটিতে শেষ পর্যন্ত গাদ্দাফী আত্মগোপন করে ছিল, তার নাম রক্বম এতনীন (এরিয়া নাম্বার টু)। আর দুর্ভাগ্যবশত আমরা ছিলাম সেই রক্বম এতনীনের ঠিক পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত জাফরানের অধিবাসী। যুদ্ধের শেষ সপ্তাহ পর্যন্তও আমরা হাজার হাজার মিজাইল, রকেট, মর্টার এবং লক্ষ লক্ষ রাউন্ড গোলাগুলির মধ্য দিয়েও সেই এলাকাতেই রয়ে গিয়েছিলাম। বাঁচব – এই আশা একেবারেই ছিল না। কিন্তু সম্ভাব্যতার সকল সূত্রকে ভুল প্রমাণিত করে শেষ পর্যন্ত আমরা বেঁচে গেছি।