ইন্দ্রিয়গুলো যখন প্রতারণা করে

বাস্তব জীবনে আমরা যা কিছু দেখি বা শুনি বলে আমাদের কাছে মনে হয়, তার সব কিছুই যে সঠিক সেটার কোন নিশ্চয়তা নেই। অধিকাংশ সময়ই আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো আমাদের সাথে প্রতারণা করে। যেমন ধরা যাক টেলিভিশন দেখার কথা। আপনি যদি একটু ভালোভাবে লক্ষ করেন তাহলে দেখতে পাবেন যে, আমরা যখন টিভিতে ফুটবল বা অন্য কোন খেলা দেখার সময় ভাষ্যকারের ধারাবর্ষ শুনি, তখন যদি ভাষ্যকারকে টিভির পর্দায় দেখায় তাহলে আমাদের কাছে মনে হয় যে কথাগুলো ভাষ্যকারের মুখ থেকেই আসছে।  কিন্তু যখন ভাষ্যকারকে না দেখিয়ে খেলোয়াড়দেরকে দেখানো হয়, তখন ধারাবর্ণনা শুনলে বোঝা যায় যে, শব্দগুলো আসলে আসছে টিভির স্পীকার থেকে। অর্থাত্‍ এক্ষেত্রে আমাদের চোখ আমাদের কানকে ধোঁকা দেয়।

আবার ধরুন সিনেমার গানের কথা। সিনেমাতে সাধারণত নায়ক-নায়িকারা নিজেরা গান গায় না। গান গায় সত্যিকারের শিল্পীরা, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা শুধু গানের সাথে ঠোঁট মিলায় বা লিপ্সিং করে। আপনার যদি প্রচুর সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা থাকে তাহলে আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে, গানের মূল শিল্পী যদি পরিচিত না হয় তাহলে কিন্তু আমরা এই ব্যাপারটা ধরতে পারি না। অর্থাত্‍ আমাদের কাছে মনে হয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই গানটা গাচ্ছে। কিন্তু যদি গানের শিল্পী বিখ্যাত কেউ হয়, যার গান শুনেই আমরা বলে দিতে পারি এটা কার গান, তখন নায়ক-নায়িকা যত নিঁখুত ভাবেই ঠোঁট মিলাক না কেন, গানটা আমাদের কাছে কেমন যেন বেমানান মনে হতে থাকে। সারাক্ষণই মনে হতে থাকে গানটাতো আসলে নায়ক বা নায়িকা গাচ্ছে না, গাচ্ছে অন্য কেউ। এক্ষেত্রে আমাদের কান আমাদের চোখকে ধোঁকা দেয়।

এ জাতীয় ঘটনাগুলোর জন্য মূলত দায়ী আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যভাগে অবস্থিত আধা ইঞ্চির চেয়েও কম ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট একটা অংশ যাকে বিজ্ঞানীরা Inferior Colliculus Region বলে থাকেন। এই অংশটা মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে কর্ণ থেকে কর্টেক্স (মস্তিষ্কের কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়াকরণ অংশ) পর্যন্ত যাওয়ার সময় সকল শব্দ তরঙ্গের জন্য একটা স্টেশন হিসেবে কাজ করে। এই অংশটা একই সাথে শব্দ এবং দৃশ্য উভয় প্রকার তথ্য নিয়েই কাজ করে। বিজ্ঞানীদের মতে ভিজুয়্যাল এবং অডিটরি ইনফরমেশনগুলো মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে একই পদ্ধতিতে এনকোডেড হয়ে থাকে এবং সে কারণেই এই ইন্দ্রিয়গুলো একে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে।

এ প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটি’স সেন্টার ফর কগনিটিভ নিউরোসায়েন্স (Duke University’s Center for Cognitive Neuroscience) এর একজন সহযোগী অধ্যাপিকা জেনিফার গ্রো (Jennifer Groh) বলেন, শ্রবণেন্দ্রিয়র জন্য দৃষ্টি কোথায় নিবদ্ধ আছে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে জার্মানীর ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর বায়োলজিকাল সাইবারনেটিক্স (Max Planck Institute for Biological Cybernetics) এর একজন গবেষক বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফ কাইজার (Christoph Kayser) এ সম্পর্কে বলেন, এই ঘটনাগুলো থেকে বোঝা যায় যে মস্তিষ্ক বিভিন্ন ইন্দ্রিয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে না রেখে যথাসম্ভব একত্রিত করে প্রক্রিয়াকরণ করে।

ম্যাজিশিয়ানরা তাদের বিভিন্ন ম্যাজিকে আমাদের মস্তিষ্কের এই ধর্মকে কাজে লাগিয়ে অডিও-ভিজুয়্যাল ইলিউশন সৃষ্টি করে থাকেন। এমনকি ভেন্ট্রিলোকুইস্টরাও (Ventriloquists) তাদের ভেন্ট্রিলোকুইজমে (Ventriloquism – মুখ না নাড়িয়ে এমনভাবে কথা বলার বিদ্যা যেন মনে হয় কথাগুলো অন্য কোন স্থান থেকে আসছে) মস্তিষ্কের এই ধর্মের সুযোগ নিয়ে থাকেন। তাদের মুখ না নাড়িয়ে এবং ভিন্ন ধরনের স্বর কম্পাঙ্ক তৈরি করার বিদ্যা এক্ষেত্রে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভূমিকা পালন করে আমাদের মস্তিষ্কের কার্যাবলি। কারণ আমাদের দৃষ্টি যখন ভেন্ট্রিলোকুইস্টের হাতের আকর্ষণীয় পুতুলটার প্রতি নিবদ্ধ থাকে, তখন আমাদের মস্তিষ্ক আমাদেরকে ভাবতে বাধ্য করে যে ভেন্ট্রিলোকুইস্টের মুখ থেকে নিঃসৃত শব্দ আসলে পুতুলটার মুখ থেকেই আসছে।

Scientific American থেকে Nikhil Swaminathan এর When the Eyes Play Tricks on the Ears অবলম্বনে।

3 thoughts on “ইন্দ্রিয়গুলো যখন প্রতারণা করে”

  1. বাহ, এইটাও তো বেশ মজার একটা ব্যাখ্যা! আমি আগে ভাবতাম ভেন্ট্রিলোকুইস্টরা বিশেষ পদ্ধতিতে কথা ছুড়ে দেয়!!! ধন্যবাদ অনেক …

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান