কোনো ঘটনায় যে লাভবান, সেই কি দায়ী?

কোনো ঘটনার পেছনে কারা জড়িত, সেটা বোঝার একটা উপায় হচ্ছে ঐ ঘটনায় কারা লাভবান হচ্ছে, সেটা লক্ষ্য করা।

কিন্তু এই পদ্ধতি কোনো ফুলপ্রুফ পদ্ধতি না। কারণ একই ঘটনায় একাধিক পক্ষ লাভবান হতে পারে। একজনের লাভের গুড় অন্য কেউও খেতে পারে। আবার আমরা যেটাকে স্বল্পকালীন লাভ মনে করছি, কোনো পক্ষ হয়তো সেটাকেই দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি মনে করতে পারে।

যেমন ধরেন, আমেরিকার ইরাক আক্রমণ। আমেরিকা তো লাভবান হয়েছেই – কোনো সন্দেহ নাই, কিন্তু লং টার্মে যদি বিবেচনা করেন, এই ঘটনায় সবচেয়ে লাভবান হয়েছে ইরান। সাদ্দাম পরবর্তী ইরাকের রাজনীতিতে, বিশেষ করে মালিকির সময়, ইরাক ছিল ইরানের ক্লায়েন্ট স্টেট। ইরাক নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণেই ইরান ধীরে ধীরে অন্যান্য এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে পেরেছে।

এটা সে সময় অনেকেই বুঝতে পেরেছিল। এমনকি ইসরায়েলও। সেজন্য ইসরায়েল, জর্ডান, সৌদিসহ আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও যুদ্ধের আগে বারবার আমেরিকাকে সতর্ক করছিল যে, তারা যদি ইরাক আক্রমণ করে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে এবং শেষপর্যন্ত ইরানই লাভবান হবে। (আমেরিকা ইরাক আক্রমণ শুরু করে দেয়ার পর অবশ্য তারা সবাই লাইনে চলে এসেছিল।)

এখন যেহেতু ইরান লাভবান হয়েছে, আমরা কি বলতে পারব আমেরিকার ইরাক আক্রমণের পেছনে আসলে ইরানই দায়ী ছিল? আপনি না মানতে পারেন, কিন্তু ইরান-বিদ্বেষী সৌদিপন্থীরা সেরকমই দাবি করে (যদিও বাস্তবে সৌদি হচ্ছে আমেরিকার প্রধান মিত্র)। এরপক্ষে তাদের যুক্তিও আছে। যে আহমেদ চালাবি ইরাক আক্রমণের ব্যাপারেে আমেরিকাকে রাজি করিয়েছিল, তার সাথে ইরানি ইন্টালিজেন্সের সম্পর্ক ছিল।

সো, ব্যাপারটা হচ্ছে, একই ঘটনায় একাধিক পক্ষ লাভবান হতে পারে, কিন্তু সেটা থেকে শর্টকাট কনক্লুশন টানা কঠিন। ইরান হয়তো লাভবান হয়েছে – কিন্তু আমেরিকা ইরানের স্বার্থে ইরাক আক্রমণ করেছে – এটা এখনও প্রো-সৌদি কন্সপিরেসী থিওরী, এর পক্ষে কোনো প্রমাণ নাই।

আরব বসন্তের কথাও ভাবতে পারেন। প্রথম যে দুইটা দেশ আরব বসন্তে আক্রান্ত হয়েছিল, তিউনিসিয়া এবং মিসর, তাদের দুই প্রেসিডেন্টই ছিল পশ্চিমা পাপেট। এবং আপনি যদি কিছু খোঁজ-খবর রাখেন, তাহলে জানার কথা, তিউনিসিয়ার আন্দোলনের সময় দুনিয়ার কেউ তিউনিসিয়ার জনগণের পক্ষে ছিল না। এমনকি আন্দোলন দমন করতে সাহায্য করার জন্য ফ্রান্স সেনাবাহিনী পাঠানোরও প্রস্তাব দিয়েছিল।

মিসরের ক্ষেত্রেও প্রায় একই ঘটনা ছিল। একমাত্র ওবামা এবং হাতে গোণা কয়েকজন ছাড়া তার প্রশাসনের প্রায় কেউই মিসরের জনগণের পক্ষে ছিল না। হিলারী ক্লিন্টনসহ সবাই চেয়েছিল মোবারককেই ক্ষমতায় রাখতে। কিন্তু ওবামা বুঝতে পেরেছিল, মোবারকের দিন শেষ, ফলে সিআইএকে দিয়ে মিসরের ইন্টালিজেন্সকে বার্তা পাঠিয়েছিল মোবারককে মোবারককে সরে যাওয়ার জন্য।

পরবর্তীতে আরব বসন্তের ধারাবাহিকতায় লিবিয়া-সিরিয়াতে এতো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে যে, এখন অনেকেরই মনে হতে পারে, এটা ছিল আমেরিকা-ইসরায়েলের ষড়যন্ত্র। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রতিটা দেশের আন্দোলনে শুরু থেকেই আমেরিকা-ইসরায়েলের যতটুকু ভূমিকা ছিল, কাতারের (আল-জাজিরার মাধ্যমে) এবং মুসলিম ব্রাদারহুডসহ ইসলামপন্থী দলগুলোর ভূমিকা অনেক অনেক বেশি ছিল।

আপনি যদি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি গভীরভাবে ফলো করেন, তাহলে আপনার জানার কথা, সৌদি আরব এবং আরব আমিরাত আরব বসন্তের ঘোর বিরোধী ছিল। নীতিগতভাবেই তারা গণতন্ত্র বা পপুলার রেভোলিউশন ধারণার বিরোধী। কারণ তাতে তাদের নিজেদের শাসনই হুমকির মুখে পড়বে। কাতার ছিল আরব বসন্তের প্রধান আইডিওলগ, কারণ কাতারের স্ট্রং ইকোনমি, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে গভীর সম্পর্কের মাধ্যমে তারা নিশ্চিত ছিল যে, নিজেদের দেশে আন্দোলন হবে না।

কিন্তু বাস্তবে কী ঘটেছে? কাতার শুরু করলেও শেষে দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারেনি। আরব স্প্রীং পরবর্তী অধিকাংশ রাষ্ট্রেই সৌদি-আমিরাতী প্রভাব বেশি শক্তিশালী। কারণটা কী? কারণ হচ্ছে, আমেরিকা এবং ইসরায়েলি কানেকশনের কারণে তারা এতোই পাওয়ারফুল, যা কিছুই ঘটুক না কেন, দুই-তিন বছর দেরি হলেও শেষপর্যন্ত সেটাকে তারা নিজের পক্ষে নিয়ে আসতে পারে। মিসরে মুরসি জিতেছিল, সৌদি-আমিরাত-ইসরায়েল হেরে যাচ্ছিল, কিন্তু সিসির মাধ্যমে তারা ঠিকই আবার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে।

অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে শেষপর্যন্ত যারা লাভবান হয়েছে, মূল ঘটনার সাথে তারা সেই অর্থে জড়িত ছিল না। এই উদাহরণ আপনি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কাজে লাগাতে পারেন। বিএনপি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করুক, বর্জন করুক, গান্ধীবাদী আন্দোলন করুক, ভাংচুর করুক – যাই করুক না কেন, কোনো লাভ নাই। শেষপর্যন্ত লাভবান আওয়ামী লীগই হবে। বিকজ দে আর সিম্পলি ঠু মাচ পাওয়ারফুল। যেটাই ঘটুক, শেষপর্যন্ত সেটাকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসার সামর্থ্য রাখে তারা।

উভয়ক্ষেত্রেই আপাতদৃষ্টিতে যাদেরকে লাভবান মনে হচ্ছে, তারা মূল ঘটনার সাথে জড়িত নাও হতে পারে। এর বাইরেও আরেকরকম ঘটনা ঘটে, যেমন ধরুন ক্রাইস্টচার্চ হামলা। হামলাটা কে করেছিল? চরম ডানপন্থী, খ্রিস্টান মৌলবাদী এক সন্ত্রাসী। কিন্তু এতে কাদের লাভ হয়েছিল? কাদের ক্ষতি হয়েছিল?

বেশিদিন আগের কথা না, তাই আপনার মনে থাকার কথা, ঐ ঘটনার পর সারা বিশ্বে মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতি এবং ডানপন্থীদের প্রতি ঘৃণা বেড়ে গিয়েছিল। এখন কি আমরা সন্দেহ করতে পারব, ঐ ঘটনার পেছনে আসলে বামপন্থীদের বা মুসলমানদের গভীর ষড়যন্ত্র ছিল? না, জাস্ট কে লাভবান হয়েছে, এই বিবেচনায় কাউকে সন্দেহ করা যায় না।

তাছাড়া ঐ ঘটনায় আপাতদৃষ্টিতে মুসলমানরা লাভবান হলেও প্রচুর উগ্র ডানপন্থী ঐ ঘটনার পর নতুন করে চরমপন্থায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সেটাও এক ধরনের লাভ, যেটাকে আমরা সাধারণত হিসাবে ধরি না।

শ্রীলঙ্কার ঘটনায় অনেকেই খুব সহজেই অমুক দায়ী, তমুক লাভবান সমীকরণ টেনে ফেলছেন। সেখানেও এই উদাহরণগুলো প্রযোজ্য।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান