মোহাম্মদ মুরসির অভিষেক

প্রেসিডেন্ট হিসেবে মোহাম্মদ মুরসির অভিষেক অনুষ্ঠানটি তার জন্য এর চেয়ে বেশি অপমানজনক হওয়া সম্ভব ছিল না।

নির্বাচনের দিন রাতে মুরসি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তিনি বিলুপ্ত পার্লামেন্টকে পুনর্বহাল করবেন এবং সেই পার্লামেন্টের সামনেই শপথ গ্রহণ করবেন। কিন্তু মিলিটারি কাউন্সিল তাকে তার প্রতিজ্ঞা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করে।

অভিষেক অনুষ্ঠানের পূর্বে দুইজন জেনারেল টেলিভিশনে এক যৌথ বিবৃতিতে প্রতিজ্ঞা করে, সামরিক বাহিনী সর্বদাই ব্যাপক ক্ষমতা সহকারে সরকারের পেছনে থেকে “বিশ্বস্ত অভিভাবক” হিসেবে ভূমিকা পালন করে যাবে।

এই ব্লগটি এখন থেকে আর আপডেট করা হবে না। আমার সবগুলো নতুন লেখা পাবেন এখানে – https://www.mhtoha.com/

কী ধরনের “অভিভাবক”?

“আপনার যেভাবে খুশি ব্যাখ্যা করে নিন”, জানিয়েছিলেন মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আল-আসার।

প্রকাশ্য অনুষ্ঠানের পরিবর্তে ২০১২ সালের ৩০ জুন, শনিবার সকাল বেলা জেনারেলরা মোহাম্মদ মুরসিকে সুপ্রিম কনস্টিটিউশনাল কোর্টের ভেতরে এক রুদ্ধদ্বার কক্ষে শপথ নিতে বাধ্য করে।

তাকে বাধ্য করা হয় সেই সব বিচারকদেরকে সম্মান প্রদর্শন করতে, যারা মুসলিম ব্রাদারহুড জয়লাভ করার পর পার্লামেন্টকে বিলুপ্ত করেছিল এবং যারা প্রেসিডেন্ট হিসেবে মুরসির জয়কেও ছিনিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।

আমি (ডেভিড কার্কপ্যাট্রিক) আমার অফিসে বসে টিভির পর্দায় দেখছিলাম, প্রধান বিচারক ফারুক সুলতান মুরসিকে সুপ্রিম কনস্টিটিউশনাল কোর্টের গুরুত্ব এবং আইনের সার্বভোমত্ব নিয়ে লেকচার দিচ্ছিলেন।

তার সামনে শূণ্য কোর্টরুমে খাড়া একটি চেয়ারে মুরসি বসেছিলেন অনেকটা জিম্মির মতো। একদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। বিড়বিড় করে ক্ষমতার পৃথকীকরণ সম্পর্কে দুই-একটা কথা বলার চেষ্টা করছিলেন তিনি। তার জন্য আমার করুণা হতে লাগলো।

কিন্তু তারপরেও রাষ্ট্রপতিত্বের ফাঁদ তাকে আরো বিশাল করে তুলেছিল। কোর্ট থেকে বেরিয়ে তিনি সেই একই কালো মার্সিডিজ গাড়িতে উঠে বসেছিলেন, যে গাড়িটি হোসনি মোবারককে বহন করে বেড়াতো। তার চারপাশে ঘিরে ছিল কালো সানগ্লাস এবং ইয়ার পিস পরা সেই একই বডিগার্ডরা, যারা মোবারককে ঘিরে রাখত।

ফিল্ড মার্শাল তানতাউই তখনও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন এবং কেউ তখনও ভাবতেও পারেনি মুরসি কখনও তানতাউইকে অপসারণ করতে পারবেন। সেই প্রবল ক্ষমতাশালী তানতাউইও নতুন প্রেসিডেন্ট মুরসিকে স্যালুট ঠুকেছিলেন।

অভিষেক নিয়ে মুরসির নিজের অবশ্য ভিন্ন পরিকল্পনা ছিল। কোর্ট থেকে বেরিয়ে তিনি সোজা গিয়ে উপস্থিত হন কায়রো বিশ্বাদ্যালয়ের লেকচার হলে। সেখানে তিনি নির্বাচিত এবং পরবর্তীতে বিলুপ্ত পার্লামেন্ট সদস্যদের এবং বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের সামনে পুনরায় নতুন উদ্দীপনায় তার শপথবাক্য পাঠ করেন।

এর আগের দিন রাতে, তাহরির স্কয়ারে তিনি অনানুষ্ঠানিকভাবে তৃতীয়বারের মতো শপথবাক্য পাঠ করেছিলেন। মুসলিম ব্রাদারহুড সদস্যরা সেখানে একটি উঁচু মঞ্চ তৈরি করেছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ, যাদের মধ্যে বেশ কিছু নন-ইসলামিস্টও ছিল, সেদিন তার বক্তব্য শুনতে উপস্থিত হয়েছিল।

খুব কম সংখ্যক মিসরীই তাদের জীবনে রক্ত মাংসের কোনো প্রেসিডেন্টকে স্বচক্ষে দেখেছিল। পূর্বের প্রেসিডেন্ট আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ায় এবং নিজেও ১৯৯৫ সালে হত্যাপ্রচেষ্টার শিকার হওয়ায় মোবারক জনসমক্ষে প্রায় আসতেন না বললেই চলে। তাকে শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের পর্দায়ই দেখা যেত, সব সময় দেহরক্ষীদের ঘন চাদরে আবৃত অবস্থায়।

সেই মিসরীদের সামনে এখন এক অগ্রদূত মঞ্চে উপবিষ্ট হয়ে ঘোষণা করলেন, “আল্লাহু আকবার”। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, এটি একটি গতানুগতিক ইসলামিস্ট র‌্যালি। মুরসি সব সময়ের মতো অপ্রতিভ অবস্থায় বক্তৃতার কাগজ এবং মাইক্রোফোন দুটোই এক হাতে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি মঞ্চের উপর এমনভাবে হাঁটছিলেন, মনে হচ্ছিল তিনি বুঝি অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের হাই টেম্পারেচার কন্ডাকটিভিটি নিয়ে লেকচার দিতে যাচ্ছিলেন।

“হে মুক্ত বিশ্ব, আরব জনগণ, আমার ভাই ও বোনেরা, পুত্র ও কন্যারা, মিসরীয় মুসলমান এবং খ্রিস্টান জনগণ, সকল নাগরিকগণ, আপনারা যে যেখানে আছেন, মিসরে কিংবা মিসরের বাইরে, আমরা আজ এখানে এসেছি বিশ্বকে জানাতে: এই হচ্ছে মিসরীয় জনগণ, এরাই হচ্ছে সেই বিপ্লবীরা, যারা এই মহাকাব্য রচনা করেছে, এই বিপ্লব …”

এই লেখাটি এবং এই বই থেকে আমার আরেকটি লেখা স্থান পেয়েছে প্রচ্ছদ প্রকাশন থেকে বের হওয়া ” প্রেসিডেন্ট মুরসি : আরব বসন্ত থেকে শাহাদাত” শিরোনামের বইয়ে।

আমার মনে হলো আমি মুরসির কণ্ঠে নতুন কিছু শুনছি। তার বক্তব্যে সেদিন ইসলাম কিংবা ইসলামিক আইন বিষয়ে কোনো বক্তব্য ছিল না। বরং তিনি থমাস জেফারসনের শহিদদের রক্ত দিয়ে স্বাধীনতার বৃক্ষে পানি দেওয়া সংক্রান্ত বক্তব্য উদ্ধৃত করেছিলেন।

তিনি তার রাজনৈতিক বিরোধীদেরকে, খ্রিস্টানদেরকে, সেক্যুলার মিসরীদেরকে এবং শিল্পীদেরকে লক্ষ্য করে কথা বলছিলেন, যারা ইসলামপন্থীদের শাসন নিয়ে ভীত ছিল। তিনি বলেছিলেন, “যারা আমাকে ভোট দিয়েছেন, এবং যারা দেননি, আমি আপনাদের সকলের জন্য। সকলের কাছ থেকে আমার অবস্থান সমান দূরত্বে।”

“আমি আপনাদের কাছে এসেছি, কারণ আপনারাই হচ্ছেন বৈধতার উৎস। আমার কথা সবাই শুনতে পাচ্ছে – সকল মানুষ, মন্ত্রিসভা, সরকার, পুলিশ, আর্মি। আপনাদের কর্তৃত্বের উপর আর কারো কর্তৃত্ব নেই। আপনারা যাকে পছন্দ করেছেন, তার হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছেন। আবার যখন প্রয়োজন মনে করবেন, ক্ষমতা সরিয়ে নিবেন।”

মুরসি জোর দিয়ে বললেন, কোনো “সত্ত্বা” বা কোনো “প্রতিষ্ঠান” জনগণের রায় অস্বীকার করতে পারবে না। কারো বুঝতে বাকি ছিল না, সত্ত্বা বা প্রতিষ্ঠান বলতে তিনি সেনাবাহিনীকেই বুঝিয়েছিলেন।

বক্তৃতার একপর্যায়ে মুরসি এক হাত দিয়ে তার দুই বডিগার্ডকে একপাশে সরিয়ে মঞ্চের একেবারে সামনে চলে আসেন। দর্শকদের কাছ থেকে মাত্র কয়েক ফিট দূরে দাঁড়িয়ে তিনি তার কোট খুলে হাতে নিয়ে নেন।

শার্টের কয়েকটা বোতাম খুলে তিনি বলতে শুরু করেন, “আমার নিজেকে বুলেট থেকে রক্ষা করার মতো কিছু নাই। আমি শুধু আল্লাহ্‌কে ভয় করি, এবং তারপর আমি ভয় করি আপনাদেরকে।” মুরসির শার্টের নিচে আসলেই মোবারকের মতো বুলেটের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বডি আর্মার ছিল না।

অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমার জামাল আব্দুল নাসেরের কথা মনে পড়ে গেল। ১৯৫৪ সালে তিনি যখন আলেক্সান্দ্রিয়ার মানশিয়া স্কয়ারে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন বুলেট এসে তার মাথার উপরে থাকা লাইট বাল্বটিকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। তার বডিগার্ডরা তাকে চার দিক থেকে ঘিরে ধরেছিল। পরে অনেকে দাবি করেছিল, নাসেরের বুকের উপর নাকি একটি কালো দাগও দেখা দিয়েছিল।

“আব্দুল নাসেরকে মেরে ফেলতে দাও। আব্দুল নাসের তোমাদের মধ্যে একজন ছাড়া আর বেশি কী?” বিন্দুমাত্র ভীত না হয়ে বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছিলেন নাসের, “তোমরা যেখানে আছ, সেখানেই থাক। আমি মরিনি। আমি বেঁচে আছি। এবং আমি যদি মারাও যাই, তাহলে তোমরা সবাই জামাল আব্দুল নাসের।”

এটা ছিল অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রার পর মিসরীয় রাজনৈতিক নাট্যমঞ্চের সেরা পর্ব। আব্দুল নাসেরের অবশ্য কোনো ক্ষতি হয়নি। শোনা যায়, তার বুকের কালো দাগটি ছিল আসলে কলমের কালির দাগ। মুরসি কি ইচ্ছে করেই ইসলামপন্থীদের চিরশত্রু আব্দুল নাসেরের স্মৃতি জাগিয়ে তুলেছিলেন?

মুরসি তার বক্তৃতায় জেনারেলদের তার ক্ষমতাহরণের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। “রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা এবং দায়িত্ব পরিত্যাগ করার কোনো অধিকার আমার নাই,” জনগণের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন তিনি, “এটা আপনাদের সাথে আমার চুক্তি। এটাই হচ্ছে আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা। … আপনারা কি প্রস্তুত? আপনারা কি আমাদের অধিকার ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় আমার পাশে এসে দাঁড়াবেন?”

মুরসি তার সেদিনের বক্তব্য দিয়ে মিসরীয়দের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইয়াসমিন আল-রাশিদি, এক অভিজাত পরিবারের লেখিকা নিউইয়র্ক রিভিউ অফ বুকসে এই দিনগুলোর বর্ণনা তুলে ধরেছিলেন।

তার বর্ণনায় মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি এক ধরনের ভয় এবং তাচ্ছিল্যের মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তিনিও মুরসির সেদিনের বক্তব্য প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “মুরসি সেদিন আমার মন জয় করে নিয়েছিলেন। তিনি আমার মায়ের মনও জয় করে নিয়েছিলেন, যদিও আমার মা সব সময়ই ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। তিনি সেদিন আরো অনেকের মনেই জয় করেছিলেন, যারা ভেবেছিল তাকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত।”

কিন্তু মুরসিকে সে সুযোগ দেয়া হয়নি।

— শেষ লাইনটা সংযোজিত। বাকিটুকু মিসরের বিপ্লব, মুরসির উত্থান এবং মিসরের ডীপ স্টেটের হাতে মুরসির পতন নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক David D. Kirkpatrick এর লেখা বই Into the Hands of the Soldiers এর একটা অংশের অনুবাদ।

2 thoughts on “মোহাম্মদ মুরসির অভিষেক”

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান