দ্য প্রেসিডেন্ট: এক পতিত স্বৈরাচারের গল্প

মহাপরাক্রমশালী প্রেসিডেন্ট তিনি। তার আঙ্গুলি হেলনে পুরো দেশ উঠে বসে। এক রাতে নিজের প্রাসাদে কাঁচের দেয়ালের ভেতরে বসে নিজের রাজধানী, আলোকসজ্জায় জ্বলজ্বল করা সিটি অফ লাইটসের দিকে তাকিয়ে সেটাই ভাবছিলেন তিনি। পাশে বসে ছিল তার কিশোর নাতি।

প্রেসিডেন্টের ছেলেকে বিদ্রোহীরা হত্যা করেছিল। নাতিই ছিল তার একমাত্র উত্তরাধিকার। নাতিকে তিনি বোঝাচ্ছিলেন, বড় হলে তাকেই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু নাতির তখন দেশ পরিচালনার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ ছিল না। সে চাইছিল আইসক্রিম খেতে।

নাতিকে ক্ষমতার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য তিনি টেলিফোন করলেন বিদ্যুৎ বিভাগে। নাতি বললেন, দেখছ এই যে কী সুন্দর আলো জ্বলজ্বল করছে? আমার নির্দেশে দেখবে এক মুহূর্তের মধ্যে সব কীভাবে অন্ধকার হয়ে যাবে, আমার আমার নির্দেশেই কীভাবে সব আলোকিত হয়ে উঠবে!

প্রেসিডেন্ট বিদ্যুৎ বিভাগকে নির্দেশ দিলেন, আমার প্রাসাদ ছাড়া পুরো শহরের ইলেক্ট্রিসিটি কেটে দাও। মুহূর্তের মধ্যে পুরো শহর অন্ধকার হয়ে গেল। নাতি মজা পেয়ে গেল। দাদার কাছ থেকে ফোনের রিসিভার নিয়ে সে নিজেই এবার নির্দেশ দিল, অন করে দাও। সাথে সাথে জ্বলে উঠল শহরের সব লাইট।

নাতি আবার নির্দেশ দিল, অফ করে দাও। আবার অন্ধকার হয়ে গেল পুরো শহর।

আবার অন করার নির্দেশ দিল নাতি। কিন্তু এবার কোনো বাতি জ্বলল না। অন কর, অন কর, বলতে লাগল নাতি। কিন্তু না, শহর আগের মতোই অন্ধকার।

প্রেসিডেন্টের মুখ রাগে লাল হয়ে গেল। নাতির হাত থেকে রিসিভার নিয়ে কঠোর স্বরে তিনি জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার? অন করছ না কেন? কিন্তু কোনো জবাব নেই।

হঠাৎ দূরে শহরের ভেতরে কোথাও একটু আলোর ঝলকানি দেখা গেল। তারপর একটু দূরে আরেক জায়গায়। তারপর একসাথে অনেক জায়গায়। না, বিদ্যুৎ আসেনি। আলোর ঝলকানির সাথে সাথে গুলি আর বিস্ফোরণের আওয়াজও আসতে শুরু করল। শহরে বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। দেশ দখল হয়ে যাচ্ছে …

ইরানি পরিচালক মোহসেন মাখমালবাফের The President (2014) সিনেমার শুরুর দৃশ্য এটি। সিনেমাটি এক প্রবল পরাক্রমশালী প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে সেনা-জনতার অভ্যুত্থানের কাহিনী। নাতিকে সাথে নিয়ে শহরের রাস্তা দিয়ে ছদ্মবেশে পালাতে চেষ্টা করা পতিত স্বৈরাচারের অসহায়ত্বের কাহিনী। জনগণের মধ্যে নিজের বিরুদ্ধে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ দেখে নিজের শাসনের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পারার কাহিনী। একটি দেশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কাহিনী।

সিনেমাতে কোনো দেশের নাম বলা হয়নি। ফিকশনাল একটি দেশের কাহিনী এটি। মোহসেন মাখমালবাফ ইরান থেকে নির্বাসিত। তাই সিনেমাটি তিনি নির্মাণ করেছেন জর্জিয়াতে। সিনেমার ভাষা এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও সেখানকার।

কাহিনীর অনুপ্রেরণা হিসেবে মাখমালবাফ উল্লেখ করেছেন তার আফগানিস্তানের প্রাসাদে ভ্রমণের কথা। কিন্তু সিনেমার কাহিনীর সাথে আফগানিস্তানের, ইরানের বা জর্জিয়ার চেয়ে বরং মধ্যপ্রাচ্যেরই মিল বেশি। বিশেষ করে আরব বসন্তের পর নির্মিত হওয়ায় এই মিলটাই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। সিনেমার শেষের দিকের একটি দৃশ্যে প্রেসিডেন্টের সাথে গাদ্দাফীরও মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

খুব বেশি অসাধারণ হয়তো বলা যাবে না, কিন্তু ভালোই লাগেছে সিনেমাটি দেখতে। প্রতিশোধের বিরুদ্ধে সুন্দর ম্যাসেজ আছে এতে। কিশোর নাতিটির অভিনয়ও ছিল দুর্দান্ত। কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার আছে সিনেমাটির ঝুলিতে। আইএমডিবি রেটিং 7.4।

সিনেমাটির নাম হিসেবে হয়তো দ্য প্রেসিডেন্টের তুলনায় দ্য ডিক্টেটরই বেশি মানাতো। কিন্তু ঐ নামটা সাশা ব্যারন কোহেন আগেই মেরে দিয়েছে।

এই সিনেমা আমার ওয়াচলিস্টে ছিল না, এটার নামও জানতাম না। কিন্তু শেষের দিকে গাদ্দাফীর সাথে একটা দৃশ্যের মিল থাকাতেই একজনে রেকমেন্ড করেছিল, সেজন্যই দেখলাম। লস হয়নি।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান